ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

একজন চিকিৎসক ও নীরব সমাজকর্মীর গল্প

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০১৬
একজন চিকিৎসক ও নীরব সমাজকর্মীর গল্প ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহের কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজের সার্জারী বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. কাজল কান্তি চৌধুরী। নামটি কিছুদিন ধরে সবার মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে।

বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার নিজ হাতে ড্রেন পরিস্কারের বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই।

ফেসবুকে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, নীল-কালো মিশ্রণের চেক শার্ট, প্যান্ট আর পায়ে হাল্কা জুতা পড়ে লাঠি হাতে নিবিষ্ট মনে ড্রেনের পলিথিন, ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করছেন এই চিকিৎসক।

আর এই ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করেন কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজের (সিবিএমসি) এ.কে.আকিব নামে এক শিক্ষার্থী। পরে ছবিটি সাড়া ফেলে দেয় জনপ্রিয় এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পরবর্তীতে ভাইরাল হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে এটি। ভরে উঠে ফেসবুকের দেয়াল। উচ্চারিত হতে থাকে নানা মন্তব্য।

প্রচারণাবিমুখ এই চিকিৎসক ও নীরব সমাজকর্মী কাজল কান্তি চৌধুরী’র এমন বিরল দৃষ্টান্ত ময়মনসিংহ নগরীতেও হয়ে উঠে আলোচনার বিষয়বস্তু। এরই সূত্র ধরেই বৃহস্পতিবার (০৭ জানুয়ারি) রাতে নগরীর ৩১০ মাসকান্দা রোডে তার বাসায় হানা দেয় বাংলানিউজের এই প্রতিবেদক।

প্রথমে কথা বলতে রাজি না হলেও অনেক অনুরোধের ঢেঁকি গলিয়ে তবেই মিনিট পনের কথা বলার অনুমতি পাওয়া গেল নীরবে কাজ করে যাওয়া পরিবেশবাদী এ চিকিৎসকের থেকে।

তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণার খালিয়াজুড়ি। প্রচার নয়, নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রত্যেকেরই সমাজ উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত এ কাজ করে যাচ্ছেন।

২০০০ সালের গোড়ার দিকে নগরীর মাসকান্দা এলাকার তিন তলা বাড়ি কিনেন ডা. কাজল কান্তি চৌধুরী। নিজের বাসার সামনের ড্রেন নিয়মিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন না করায় ময়লা-আবর্জনা আর পলিথিন জমে যাওয়ায় দুর্গন্ধ ছড়াতো। এতে করে পরিবেশও ছিল হুমকির মুখে। সেই থেকেই নিজের বাড়ির সামনের ড্রেন নিয়মিত পরিস্কার করার কাজ শুরু করেন তিনি।

পরবর্তীতে নিজের কাজ শেষে বাড়ি ফিরে প্রায় প্রতি রাতে অনেকটা নিয়ম করে নগরীর পলিটেকনিক মোড় থেকে বিসিকের মোড় পর্যন্ত ড্রেন নিজ হাতে পরিস্কারের কাজে লেগে পড়েন তিনি। এক সময় তিনি ধরে নেন এটাও তার একটি কাজ। কিন্তু তিনি কখনো এ বিষয়টি কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করেননি।

একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক হয়েও আপনি এ কাজ করেন, সহকর্মীরা কিছু বলে না এমন প্রশ্নের উত্তরে হেসে উঠেন তিনি।

প্রতি উত্তরে তিনি বলেন, আমার অনেক সহকর্মী বলেন আপনি এ কাজ করেন কেন? আমি বলি, এ কাজ করলে সমস্যা কোথায়?

ফেসবুকে ভাইরাল হিসেবে ছড়িয়ে পড়া ছবির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে আবারো এ নিয়ে রিপোর্ট না করতে অনুরোধ করেন হৃদয়বান এ মানুষটি।

তিনি বলেন, শীতের জন্য এখন রাতে কাজ করতে পারি না। এ কারণেই বুধবার (০৬ জানুয়ারি) বিকেলে ড্রেন পরিস্কারের সময় স্থানীয় এক তরুণ হঠাৎ এগিয়ে এসে ছবি তুলে। আমি তুলতে নিষেধ করলেও ওই তরুণ ছবি তুলে। পরে আমার বড় ছেলের স্ত্রী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে ফেসবুকে ছবি দেয়ার বিষয়টি জানায়।

মানবকল্যাণের ব্রত নিয়ে শৈশবেই সামাজিক কাজকর্মের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন ডা. কাজল কান্তি চৌধুরী। ওই সময় তিনি নেত্রকোণার একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। বন্যার পানিতে ওই সময় নিজের গ্রামের নাওটানার বাঁধ ভেঙে যাবার উপক্রম হয়।

গ্রামবাসীরা প্রতি বাড়ি থেকে একজন করে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করার ডাক দেয়। সেইদিন চিকিৎসক বাবা জগেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী ওই কাজে পাঠিয়েছিলেন তার বড় ছেলে এই কাজল কান্তি চৌধুরীকে।

এখানেই শেষ নয়। ১৯৭৬ সালের ঘটনা। কাজল কান্তি তখন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পঞ্চম ব্যাচের ছাত্র। বাঘমারা পানির ট্যাঙ্কির নিচে ইট বিছিয়ে সব শিক্ষার্থীরা মিলে সড়ক নির্মাণ করেছিলেন।

দৈনিক বাংলা পত্রিকায় ‘অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত’ নামে সেই খবর ছাপাও হয়েছিলো বলে জানালেন কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজের সার্জারী বিভাগের এ বিভাগীয় প্রধান।

তবে নিজের বাড়ির সামনে এলাকার ড্রেন পরিস্কারের ঘটনাটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হবে এটি কখনও ভাবেননি তিনি।

ফেসবুকে ছবি ছড়িয়ে পড়ায় বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি জানান, কাউকে এ কাজে উদ্ধুদ্ধ করতে নয়, নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই এ কর্মযজ্ঞ করে যাচ্ছেন তিনি।

তিনি বলেন, প্রত্যেক মানুষের উচিত পরিবেশের জন্য কাজ করা। সেটা নিজের বাড়ি থেকেই শুরু করা উচিত।

‘স্যার, প্রচারণার আলো থেকে দূরে থাকতেই ভালবাসেন। তিনি সৎ এবং নীতিবান। সবার স্বার্থের কথা ভেবেই তিনি কাজ করেন। তবে স্যার আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, নিজের কাজ নিজেরই করা উচিত।

বলছিলেন কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজের ১৭ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী তৌহিদুল হক সোহান। তার মতো অভিন্ন মন্তব্য করেন একই ব্যাচের শিক্ষার্থী মাজাহারুল ইসলাম মিতু, তানভীর হোসেন ও নাহিদ ইউসুফ।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৬
আরএইচএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।