ঢাকা, বুধবার, ০ মাঘ ১৪৩১, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

যে কারণে গ্রামের নাম ‘মানুষমারা’

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২০
যে কারণে গ্রামের নাম ‘মানুষমারা’

নীলফামারী: নীলফামারী সদরের পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের ‘মানুষমারা’ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম বদলিয়ে ‘মানুষগড়া’ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তনের দাবি ওঠে। এ নিয়ে চলে নানা আলোচনা-সমালোচনাও।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অফিস সূত্রে জানা যায়, এখন থেকে পঞ্চপুকুর ইউনিয়নে অবস্থিত ৩৪ নম্বর বিদ্যালয়টি ‘মানুষগড়া’ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে পরিচিতি পাবে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

জানা যায়, এ অঞ্চলের এক সময় নীল চাষ হতো। সে কারণে ব্রিটিশরা এই এলাকায় বিপুলসংখ্যক নীলকুঠি বা নীলখামার গড়ে তোলে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে এ অঞ্চলের বড় বড় জমিদারিগুলো ভেঙে নতুন নতুন জমিদারি সৃষ্টি হয়। এ সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা সুযোগ মতো নিজেদের নীল চাষের ব্যবসায় সম্পৃক্ত করতে থাকে ও গড়ে তোলে একের পর এক নীলকুঠির শাসন। তখন ওই গ্রামের কৃষকরা ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তারা নীল চাষে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। এতে গ্রামের কৃষকদের ধরে নিয়ে গিয়ে পাশ্ববর্তী টেঙ্গনমারী এলাকায় নির্যাতন চালাতো ইংরেজ বেনিয়া ও তাদের এ দেশীয় দালালরা। এমন কি ওই দালালদের সঙ্গে গ্রামে বিবাদ ও সংঘর্ষ হতো। তারা গ্রামের মানুষদের মারতো। এমন মারতো যে কারো কারো হাত অথবা পা ভেঙে দিয়েছিল। সেই থেকে গ্রামটির নাম হয় ‘মানুষমারা’।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সূত্র মতে, এই গ্রামের মানুষ ১৯৩৫ সালে মানুষমারা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিল। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে স্কুলটি সরকারিকরণ হয়। স্কুলটির সরকারিভাবে পাকা ভবন হয় ১৯৯৬/৯৭ অর্থ বছরে। যা মানুষমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি পায়। এখন এটি মানুষগড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল। স্কুলটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২০ জন। প্রধান শিক্ষকসহ চারজন শিক্ষক রয়েছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) তাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, প্রাথমিক পাঠ্যবইয়ের মলাটের পেছনে সংযোজিত নতুন দুই লাইনের একটি স্লোগান রয়েছে ‘শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’। সেখানে কমলমতি শিশুদের স্কুলের নাম যদি হয় ‘মানুষমারা’ সেখানে শিশুরা খুঁজে পাবেনা কোনো নান্দনিক ভারসাম্য। বিষয়টি আমরা স্থানীয় সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নুর ও জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরীর সহযোগিতায় স্কুলটির নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব পাঠাই।

জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, নীলফামারীতে আমি যোগদানের পর স্কুলটির নাম নজরে আসে আমার। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সহযোগিতায় নাম পরিবর্তন নিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশে সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উপ-সচিব জাহানারা রহমান একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নাম পেল বিদ্যালয়টি। এখন আর ‘মানুষমারা’ নয়, ‘মানুষগড়া’ হিসেবে পরিচিতি পাবে স্কুলটি।

>>>স্কুলের নাম ‘মানুষমারা’ থেকে ‘মানুষগড়া’ 

স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মেঘা, চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী তারামনি ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী অনুরাধা বাংলানিউজকে জানায়, ‘মানুষমারা’ নাম পরিবর্তনে আমার অনেক খুশি। তারা এ সময় একসঙ্গে স্লোগান দেয় ‘শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’। বদলেছে ‘মানুষমারা’ হলাম এখন ‘মানুষ গড়া’।

নাম পরিবর্তনে স্থানীয় মানুষজনও অনেক খুশি। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি মোজারুল হক (৮০) বলেন, স্কুলের নাম পরিবর্তন হয়েছে। আমরা অনেক খুশি। এখন আমরা গ্রামের ও মৌজার নাম পরিবর্তন করতে চাই। কারণ বিভিন্ন এলাকার মানুষজন এসে যখন শোনে ‘মানুষমারা’। তখন ভয় পেয়ে যায় এই নাম শুনে।

এলাকাবাসী জানায়, আমরা এখন গ্রামের নামটিও ‘মানুষমারা’ রাখতে চাইনা। গ্রামের মানুষজন জানায় আমরা এখন ভুলে যেতে চাই নীল কর ইংরেজ বেনিয়াদের মানুষমারার সেই ঘটনাগুলো। আমরা গ্রামবাসী স্কুলটির মতো গ্রামটিতেও মানুষ গড়তে চাই।

প্রধান শিক্ষক কামরুজ্জামান মিলন বাংলানিউজকে জানান, স্কুলটির মানুষমারা নাম পরিবর্তনের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য, ডিসি স্যার ও আমাদের শিক্ষা কর্মকর্তারা এক সঙ্গে কাজ করায় আজ আমরা মানুষগড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ পেলাম। তিনি স্কুলটিকে একটি মডেল স্কুলের রূপ দিতে চান। অচিরেই স্কুলের ‘মানুষমারা’ নামের লেখা পরিবর্তন করে ‘মানুষগড়া’ লেখা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২০
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।