ঢাকা, বুধবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

করোনা টিকা: ২৩ হাজার কোটি টাকার ‘গড়মিল’ দেখছে টিআইবি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০২২
করোনা টিকা: ২৩ হাজার কোটি টাকার ‘গড়মিল’ দেখছে টিআইবি ড. ইফতেখারুজ্জামান

ঢাকা: কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া টিকা কার্যক্রমে অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি পেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকার হিসাব পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এক গবেষণা প্রতিবেদন উত্থাপনের মাধ্যমে এই দাবি করে টিআইবি।

টিআইবি জানিয়েছে, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত একজন রোগীকে গড়ে সাড়ে চার লাখ টাকার বেশি ব্যয় করতে হয়েছে।

সরকারি হাসপাতালে এই ব্যয়ের পরিমাণ গড়ে প্রায় ৩৬ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ কয়েক গুণ বেশি। বেসরকারি হাসপাতালের এ ব্যয় রোগীর জন্য অর্থনৈতিক বোঝা।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ২০২১ সালের জুলাইয়ে গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, টিকাপ্রতি ৩ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে।  পরে ২০২২ সালের ১০ মার্চ গণমাধ্যমে টিকা কার্যক্রমে মোট ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা বলে উল্লেখ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সরকারি তথ্য মতে, ৩১ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত মোট ২৪.৩৬ কোটি ডোজ টিকাদান করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের টিকা পরিকল্পনায় টিকা কার্যক্রম সম্পর্কিত ব্যয় টিকা প্রতি দুই ডলার (১৭০ টাকা) হিসেবে ধরা হয়।

এছাড়া কোভ্যাক্স রেডিনেস অ্যান্ড ডেলিভারি ওয়ার্কিং গ্রুপের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের টিকা কার্যক্রম সম্পর্কিত ব্যয়ের মডেল করা হয়, যেখানে একটি দেশের টিকা কার্যক্রমে বিদ্যমান অবকাঠামো ও জনবল ব্যবহার এবং আউটরিচ কেন্দ্রের অনুপাত বিবেচনায় টিকা ক্রয়ের পর থেকে মানুষকে টিকা দেওয়া পর্যন্ত সব ব্যয় হিসাব করে টিকা প্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ০.৮৪ ডলার (৭১.৪ টাকা) থেকে ০২.৬৪ ডলার (২২৪.৪ টাকা)। সেই হিসাবে টিকা কার্যক্রম সংক্রান্ত ব্যয়ের প্রাক্কলিত পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৩৯.৬ কোটি টাকা থেকে ৫ হাজার ৪৬৭.৩ কোটি টাকার মধ্যে। জাতীয় টিকা পরিকল্পনায় প্রাকল্লিত ব্যয় ৮ হাজার ১৪২ কোটি টাকা এবং টিকার প্রাক্কলিত মূল্য ১১ হাজার ২৫৪ দশমিক ৪ কোটি টাকা।

টিকার প্রক্কলিত ক্রয়মূল্য ও টিকা ব্যবস্থাপনার প্রাক্কলিত মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১২ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা থেকে ১৬ হাজার ৭২১ কোটি টাকা, যা স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রদত্ত হিসাবের অর্ধেকেরও কম। শুধু একটি দেশের ক্ষেত্রে টিকার ক্রয়মূল্য প্রকাশ না করার শর্ত থাকলেও অন্যান্য উৎস থেকে কেনা টিকার ব্যয় এবং টিকা কার্যক্রমে কোন কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে তা প্রকাশ করা হয়নি।

গবেষণা প্রতিবেদনে টিকা কার্যক্রমের বেশ কিছু ঘাটতির কথা উল্লেখ করা হয়।

কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম-দুর্নীতি টিকা কেন্দ্রে টিকা গ্রহণের সময় ২ শতাংশ সেবাগ্রহীতা অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে সময়ক্ষেপণ, টিকা কেন্দ্রে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সুবিধা দেওয়া, দুর্ব্যবহার এবং কিছু কেন্দ্রে টিকা থাকা সত্ত্বেও টিকা কেন্দ্র থেকে টিকাগ্রহীতাদের ফিরিয়ে দেওয়া উল্লেখযোগ্য।

টিকা কেন্দ্রে অতিরিক্ত ভিড় এড়িয়ে যথাসময়ে বা দ্রুত টিকা পেতে ১০.১ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে গড়ে ৬৯ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এছাড়া প্রবাসীরা টিকার নিবন্ধনের জন্য বিএমইটি নম্বর পেতে ১৫০-২০০ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে। দু’একটি কেন্দ্রে নিয়মবহির্ভূতভাবে ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে পছন্দ অনুযায়ী টিকা প্রদান করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে টিকা না নিয়েও টাকার বিনিময়ে প্রবাসীরা টিকা সনদ সংগ্রহ করতে হয়েছে। টাকার বিনিময়ে টিকা করা একটি গ্রুপ ফেসবুক পেজে প্রবাসীদের চাহিদা অনুযায়ী টাকার বিনিময়ে টিকা সার্টিফিকেট দেওয়ার বিষয়ে প্রচার করতে দেখা গেছে।

টিকা কার্যক্রমে অসমতা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এলাকায় উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রচার কার্যক্রমে ঘাটতি, টিকা বিষয়ক তথ্যপ্রাপ্তিতে ঘাটতি, টিকা প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজ না করা, টিকা কেন্দ্রে বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যবস্থা না রাখা, টিকা কার্যক্রমে অব্যবস্থাপনা, কোভিড-১৯ চিকিৎসা সেবা ও নমুনা পরীক্ষায় অনিয়ম-দুর্নীতি, টিকাগ্রহীতাদের উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রচার কার্যক্রমে ঘাটতি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং প্রস্তাবিত কৌশল বাস্তবায়নে ঘাটতির বিষয়ও উঠে এসেছে গবেষণায়।

তবে টিআইবির গবেষণায় ইতিবাচক দিকও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত সরকার টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। একক উৎসের ওপর নির্ভরতার ফলে ২৬ এপ্রিল ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পরে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করে। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে চীন থেকে টিকা ক্রয়, কোভ্যাক্স উদ্যোগ থেকে কস্ট শেয়ারিং বা বিনামূল্যে টিকা সংগ্রহ এবং বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত অনুদান দিয়ে জুলাই ২০২১ থেকে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয়।

টিকা সংগ্রহে সরকারের তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ২৯ দশমিক ৬৪ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। সংগৃহীত টিকা থেকে ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ১২ দশমিক ৭৭ কোটি মানুষকে প্রথম ডোজ (মোট জনসংখ্যার ৭৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ) এবং ১১ দশমিক ২৪ কোটি মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ (৬৬ শতাংশ) টিকার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু করা হয় ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে এবং এ সময়ের মধ্যে প্রায় ৯৫ লাখ মানুষকে বুস্টার ডোজ টিকার আওতায় নিয়ে আসা হয়। বিভিন্ন পেশা-জনগোষ্ঠীর মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, কমিউনিটি ক্লিনিক ইত্যাদি থেকে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এছাড়া ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুলশিক্ষার্থী, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, বস্তিবাসী ও ভাসমান জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০২২
ইইউডি/এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।