ঢাকা, বুধবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

নদীকে খাল বানিয়ে খনন

বিলুপ্তির পথে জীবনানন্দের প্রিয় ধানসিঁড়ি নদী

এইচ এম নাঈম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০২২
বিলুপ্তির পথে জীবনানন্দের প্রিয় ধানসিঁড়ি নদী খননে দুর্নীতি, ধানসিঁড়ি নদী এখন সরু খাল

ঝালকাঠি: ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে—এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়—হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে’- রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ এক সময়ের প্রমত্তা ধানসিঁড়ি নদীর তীরে ভিন্ন রূপে বার বার ফিরে আসার সংকল্প করেছিলেন। কিন্তু সেই ধানসিঁড়ি নদীকে আজ মরা খালে রূপান্তর করা হয়েছে।

বার বার খননের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে, তবুও যৌবনের খরস্রোতা রূপ ফিরে পায়নি এ নদী। সম্প্রতি ঝালকাঠির এই ঐতিহ্যবাহী ধানসিঁড়ি নদী পুনঃখননেও অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

১৯১০ সালের সি এস নকশা অনুযায়ী ৩৬০ দাগে রাজাপুরের বাঘরী অংশে এ নদীর মোহনার প্রশস্ততা ছিল ৫৬৭ ফুট। তখন এই নদীতে বড় বড় জাহাজ চলত। এই ধানসিঁড়ি নদীর মোহনায় তখন ছিল দক্ষিণ বঙ্গের সবচেয়ে বড় বন্দর। এখানে কলকাতা থেকে সরাসরি জাহাজ এসে ভিড়ত। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সরকারের জরিপে ০১নং দাগে ধানসিঁড়ি নদীর মোহনার প্রশস্ততা পাওয়া যায় ২শ ফুট। এই জরিপের নকশা ২০২২ সালে এখনও চলমান। অথচ ২শ ফুট প্রশস্ত এই নদীর বর্তমানে অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।

ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য মতে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ডেল্টাপ্লান অনুযায়ী ৬৪ জেলার অভ্যন্তরে ছোট নদী, খাল খনন প্রকল্পের আওতায় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঝালকাঠি জেলার ধানসিঁড়ি নদীটি ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ২ বছর মেয়াদে দুই কিস্তিতে সাড়ে ৮ কিলোমিটার পুনঃখননের জন্য প্রায় ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ ঐতিহ্যবাহী নদীটি ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান নদীর মোহনা থেকে দেড় কিলোমিটার বাদ দিয়ে রাজাপুর উপজেলার বাঘরি বাজারের জাঙ্গালিয়া নদীর মোহনা পর্যন্ত মোট সাড়ে ৮ কিলোমিটার খনন শুরু হয়। প্রকল্পের কার্যাদেশে নদীর উপরে প্রস্থ ৮০ ফুট ও সমতল থেকে নদীর গভীরতা ১৫ ফুট এবং নদীর তলদেশে প্রস্থ ২০ ফুট করা হয়। কার্যাদেশে আরও উল্লেখ করা হয়, নদীর তলদেশ থেকে মাটি কেটে পাড় থেকে দূরে সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু তখন খনন কাজে পাউবোর সঠিক তদারকি না থাকায় নদী খননে বাস্তবে এর সঙ্গে মিল না রেখে ঠিকাদার কাজ শেষ করলে খননকালেই ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।

পরবর্তীতে বর্ষা মৌসুমে খনন করে নদীর পাড়ে রাখা মাটি আবার নদীতে পড়ে তলদেশ ভরাট হয়ে গেলে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে পুনরায় খননের জন্য প্রস্তাব পাঠায় পাইবো। এর প্রেক্ষিতে নতুন করে নদীর তলদেশ খননের জন্য ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। এবার কাজ পায় পটুয়াখালীর ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদ। তিনি গত ১৫ দিন আগে ধানসিঁড়ি নদীর তলদেশ খননের কাজ শুরু করেছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সঠিক ভাবে খননের অভাবে ধানসিঁড়ি নদীতে পানির প্রবাহ না থাকায় দুই পাড়ে কয়েক হাজার হেক্টর জমি অনাবাদী পড়ে আছে। পানির অভাবে শুকনো মৌসুমে কৃষকরা জমিতে চাষাবাদ করতে পারছেন না তেমনি। আর বর্ষা মৌসুমে জমিতে আটকে পড়া পানি নিষ্কাশনের ব্যাবস্থা না থাকায় আমন ও ইরি ধান চাষে বিঘ্ন ঘটছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, গত দুই বছর আগেও যে নদীর প্রশস্ততা ৮০ ফুট রেখে খনন করা হয়েছিল সেই নদীর প্রশস্ততা এবার খননে ৪৯ থেকে ৫৫ফুট রাখা হয়েছে। যা একটি খালের সমান। এবার নদীর তলদেশের মাটি উঠিয়ে নদীর পাড়ে ফেলে প্রশস্ততা কমিয়ে ফেলা হয়েছে। স্থানীয়রা আরও অভিযোগ করেন, আমরা লোক দেখানো এ খনন চাই না, এসএ নকশা অনুযায়ী এ নদীর খনন চাই।

স্থানীয় রফিক হাওলাদার বলেন, নদীর তলদেশ খনন করে মাটি দূরে সরানোর কথা থাকলেও ঠিকাদাররা ইচ্ছে করেই তা নদীর পাড়ে রাখে। ফলে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই মাটি নদীতে পড়ে আবার ভরাট হয়ে যায়। এভাবে বছর বছর টেন্ডারে কোনো কাজ তো হচ্ছেই না বরং প্রতি বছর সরকারি কোটি কোটি টাকার আত্মসাৎ করছেন একটি চক্র। ২০১০-১১ অর্থবছরেও প্রায় ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ধানসিঁড়ি নদীটি খনন করা হয়েছিল। যা পরবর্তীতে কোনো কাজে আসেনি। আসলে ধানসিঁড়ি নদীটি এখন ওই চক্রের কাছে সোনার ডিম পাড়া হাঁসে পরিণত হয়েছে।

ঝালকাঠি পাউবোর প্রকৌশলী রাকিব হাসান বলেন, ধানসিঁড়ি নদীর শুধুমাত্র তলায় চার ফুট খনন করা হচ্ছে। উপরের প্রশস্ততা এর আগে যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। খননে ঠিকাদার কিছু কিছু জায়গায় ভুল করেছিল, স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে সেগুলো ঠিক করতে বলা হয়েছে। খননকৃত মাটিগুলো এখন নদীর পাড়ে রাখলেও কাজ শেষে সেগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, ১২ এপ্রিল, ২০২২
এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।