কক্সবাজার: শূন্য রেখার রোহিঙ্গাদের তাড়ানোর জন্য গুলিবর্ষণ, ঢিল ছোঁড়া, কাঁটাতারের কাছে মাইন পুঁতে রাখাসহ নানা পাঁয়তারা চালাচ্ছে মিয়ানমার বাহিনী। কয়েকদিন আগে তাদের ছোড়া মর্টার শেলে শূন্য রেখায় নিহত হয় মো. ইকবাল নামে এক রোহিঙ্গা যুবক।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম কোনারপাড়া নো ম্যানস ল্যান্ডে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নেতা (মাঝি) দীল মোহাম্মদ এভাবেই জানালেন সীমান্ত পরিস্থিতির কথা।
দীল মোহাম্মদ বলেন, ভালো নেই শূন্যরেখার রোহিঙ্গারা। মিয়ানমার বাহিনী যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তাতে আমরা নিরাপদ বোধ করছি না।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে উখিয়া-টেকনাফের পাশাপাশি বাংলাদেশ- মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম কোনারপাড়ার শূন্য রেখায় আশ্রয় নেয় ছয় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।
দিল মোহাম্মদ বলেন, শুরুর দিকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গা এখানে বসবাস করলেও বর্তমানে ৬৬২২ পরিবারের ৪ হাজারের কিছু বেশি রোহিঙ্গা আছে। সম্প্রতি আতঙ্কের কারণে কিছু রোহিঙ্গা গোপনে বড় ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
দীল মোহাম্মদ বলেন, রোহিঙ্গা যুবক মারা যাওয়ার পর থেকে আমরা এখানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। যে কারণে নিরাপত্তা চেয়ে আমরা জাতিসংঘের কাছে ইমেইলে পাঠিয়েছি।
‘আমরা চিঠিতে জাতিসংঘকে জানিয়েছি, মিয়ানমার সামরিক জান্তা বাহিনী যেকোনো মুহূর্তে শূন্য রেখায় বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে শূন্য রেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং দ্রুত প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়েছি। ’ যোগ করেন দীল মোহাম্মদ।
ভালো নেই শূণ্য রেখার রোহিঙ্গারা
‘ছেলে মেয়েদের লেখা-পড়ার জন্য কোনো স্কুল নেই, ভালো চিকিৎসার সুযোগ নেই, থাকা-খাওয়ার সমস্যা, বর্ষাকালে বন্য আতঙ্ক, ধানের মৌসুমে হাতি আতঙ্ক- সবমিলে এখন নানা সমস্যায় নো ম্যানস ল্যান্ডের রোহিঙ্গারা। ’ এভাবেই বললেন ক্যাম্পের বড় ব্লকের মাঝি আবু জামিল (৩৫)।
জামিল আরও বলেন, এখানকার প্রধান সমস্যা থাকার ঘরগুলো খুব জরাজীর্ণ। বর্ষাকালে পানিতে তলিয়ে যায়। উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে ঘর বা শেল্টার নির্মাণ করে দেওয়া হলেও এখানে সেই সুবিধা নেই। এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমার বাহিনীর আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য নানা ষড়যন্ত্রে আমরা অতিষ্ট হয়ে উঠছি।
তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের দেশ নয়, আমরা অধিকার নিয়ে দ্রুত নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। ’
রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, এখানকার কোনো রোহিঙ্গার জটিল কোনো শারীরিক সমস্যা দেখা দিলেও বড় হাসপাতালে নেওয়া যায় না। বিজিবির অনুমতি সাপেক্ষে বড়জোর উখিয়া বেসরকারি সংস্থার হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়া যায়।
রোহিঙ্গারা জানান, কোনারপাড়া নো ম্যানস ল্যান্ডের আশপাশেই মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির ১১টি অস্থায়ী পোস্ট আছে। এছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের পাশেই রয়েছে বিজিপি রাইট ক্যাম্পটি (স্থায়ী ক্যাম্প)। যে কারণে এরা চাইলেই যেকোনো কিছু করতে পারে।
শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নেই
ক্যাম্পের হেড মাঝি দিল মোহাম্মদ জানান, গত পাঁচ বছরে এখানে জন্ম হয়েছে প্রায় ২০০ শিশুর। এছাড়া নো ম্যানস ল্যান্ডে ৬ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু আছে প্রায় চারশো। কিন্তু প্রায় চার বছর হলেও শিশুদের পড়ালেখার জন্য কোনো স্কুল বা মাদ্রাসা নেই।
এ অবস্থায় ক্যাম্পের ভেতরে নিজেদের উদ্যোগে বড় ব্লকে দুটি, উত্তর ব্লকে একটি এবং মাঝের ব্লকে একটি স্কুল ঘরের মতো করা হয়েছে। সেখানে কয়েকজন রোহিঙ্গা যুবক নিজেদের মতো করে রোহিঙ্গা শিশুদের পড়ালেখা করান।
বড় ব্লকের শিক্ষক মো. রফিক (৩০) বলেন, ক্যাম্পের তিনটি ব্লকে চারটি অস্থায়ী পাঠদান কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে শিক্ষক আছেন দুইজন করে। তারা অনেকটা স্বেচ্ছাশ্রমে ক্যাম্পের প্রায় ৪শ শিশুকে যতটুকু সম্ভব পাঠদান করছেন। মূলত তাদের ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষা পড়ানো হয়।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের আগে পরে প্রায় সাড়ে আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এ সময় বেশিরভাগ রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফের পাহাড়ী এলাকায় আশ্রয় নিলেও প্রায় সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় সীমান্তের কোনারপাড়া নো ম্যানস ল্যান্ডে।
এছাড়া নতুন পুরনো মিলে বর্তমানে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরের ঘিঞ্জি পরিবেশে ঝুপরি ঘরে বসবাস করছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২
এসবি