ঢাকা, রবিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ভুয়া মামলা দেখিয়ে সাড়ে ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ, আইনজীবীর দণ্ড

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০২২
ভুয়া মামলা দেখিয়ে সাড়ে ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ, আইনজীবীর দণ্ড মনসুর আহম্মদ দুলাল।

লক্ষ্মীপুর: ভুয়া মামলার কথা বলে প্রতারণা করে এক প্রবাসীর কাছ থেকে টাকা আত্মসাতের মামলায় লক্ষ্মীপুরে মনসুর আহম্মদ দুলাল নামে এক আইনজীবীকে ১৮ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়।

একই মামলায় আদালত তার সহযোগী আনসার উল্যা চৌকিদার নামে আরেক প্রতারককে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের সাজার রায় দিয়েছেন।  

তবে আইনজীবী মনছুর আহম্মদকে আপিল সাপেক্ষে এবং দুই শর্তে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছেন আদালত। আর আনসার উল্যা জরিমানার পাঁচ হাজার টাকা পরিশোধ করে মুক্তি পেয়েছেন।  

মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) দুপুরে লক্ষ্মীপুর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক নুরশাত জামান এ রায় দেন।  

আদালতের পেশকার মো. সাইফুদ্দিন রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।  

তিনি বলেন, এটি আইনজীবীর প্রথম অপরাধ বিবেচনায় রেখে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছেন আদালত। কারাদণ্ডাদেশ ও জরিমানা পরবর্তী দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। প্রবেশন হলো- তিনি দুই বছর গরিব ও অসহায়দের পক্ষে মামলায় লড়বেন। পাশাপাশি কোনো আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে ভুক্তভোগীর হয়ে তাকে মামলায় লড়তে হবে।

মামলার বাদী নুর নবী বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, আদালতে মামলা চলাকালীন তার পক্ষে কোনো আইনজীবী কাজ করেননি। তাই তিনি নিজেই মামলাটি পরিচালনা করেন। আদালত পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন ও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এ রায় দিয়েছেন।

তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে ও তার ছেলের বিরুদ্ধে অস্ত্র, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে মামলা রয়েছে। ওই মামলা থেকে তাদের পরিত্রাণ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে কৌশলে ১০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন দণ্ডপ্রাপ্ত এ দুইজন।

পরে তার অভিযোগের ভিত্তিতে আদালত লক্ষ্মীপুর সদর থানাকে এফআইআর দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন। ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর সদর থানায় আইনজীবী মনছুর আহম্মেদ দুলাল ও চৌকিদার আনসার উল্যার বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি।

প্রতারণা মামলার বাদী জেলার রায়পুর উপজেলার বামনী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত মোহাম্মদ মিয়ার ছেলে। তিনি একজন দুবাই প্রবাসী ছিলেন।  

দণ্ডপ্রাপ্ত আইনজীবী মনছুর আহম্মদ দুলাল একই উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামের আলী আহাম্মদের ছেলে। আরেক দণ্ডপ্রাপ্ত আনসার উল্যা বামনী ইউনিয়নের শিবপুর গ্রামের মৃত নুর মোহাম্মদ ঢালীর ছেলে এবং বাদীর প্রতিবেশী।  

মামলার এজাহার ও পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে জানা যায়, বাদী নুর নবী একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ। তিনি ৩০ বছর দুবাই ছিলেন। তার সংসারে স্ত্রী এবং দুই সন্তান রয়েছে। বড় সন্তান দুবাই প্রবাসী। ছোট ছেলে ঢাকায় লেখাপড়া করতেন। তার স্ত্রী বাড়িতে একাই থাকতেন। নুর নবী তার স্ত্রীর কাছে লাখ লাখ টাকা পাঠাতেন। নুর নবীর স্ত্রীর সঙ্গে মামলার ২ নম্বর আসামি আনসার উল্যা চৌকিদারের অবৈধ সম্পর্ক তৈরি হয়। এজন্য নুর নবীর সঙ্গে তার স্ত্রীর দূরত্ব সৃষ্টি হয়।  

নুর নবী বিদেশ থেকে দেশে এসে ৮০ লাখ ৮০ হাজার টাকায় একটি জমি বিক্রি করে নিজের একাউন্টে রাখেন। ওই টাকা নিয়েও তার স্ত্রীর সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। তাদের বিরোধ মীমাংসা করে দেওয়ার নাম করে মামলার ২ নম্বর আসামি আনসার উল্যা তাকে আইনজীবী মনসুর আহম্মদ দুলালের কাছে নিয়ে যান। ওই আইনজীবী প্রথম দিন দেখা না করে পরেরদিন দেখা করতে বলেন। পরের দিন তার সঙ্গে দেখা করলে আইনজীবী দুলাল প্রবাসী নুর নবীকে জানান, তার ছোট ছেলের বিরুদ্ধে ঢাকার তেজগাঁও থানায় অস্ত্র আইনে মামলা রয়েছে। ৫ লাখ টাকা দিলে সেই মামলার বিষয়টি তিনি সমাধান করে দেবেন। পরে নুর নবী ওই আইনজীবীকে ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর সাড়ে তিন লাখ টাকা দেন। আইনজীবী দুলাল ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি নুর নবীকে একটি রিকল দেন, যা জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে।  

ফের আইনজীবী দুলাল বরিশাল আদালত থেকে নুর নবীর নামে একটি ডাকাতি ও হত্যার মামলা লক্ষ্মীপুর আদালতে এসেছে জানিয়ে তার কাছ থেকে আবারও পাঁচ লাখ টাকা দাবি করলে নুরনবী তিন লাখ ত্রিশ হাজার টাকা দেন। কয়েকদিন পর নুর নবীর নামে চান্দিনা থানা থেকে একটি মামলা এসেছে জানিয়ে আরও পাঁচ লাখ টাকা দাবি করলে তিনি তিন লাখ ২৫ হাজার টাকা দেন। এছাড়া বাড়ির একটি বাটোয়ারা মামলার রায় করিয়ে দেবে বলে আরও ৫০ হাজার টাকা নেন দুলাল।  

বাদীর অভিযোগ, বার বার কৌশলে তার কাছ থেকে মোট ১০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আইনজীবী দুলাল। তার সহযোগী আনসার উল্যা সে টাকার ভাগ পেয়েছেন। প্রতারণার বিষয়টি তিনি বুঝতে পেরে রায়পুর থানায় প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করলে নুর নবীর কাছ থেকে জোরপূর্বক ও তার স্ত্রীর সঙ্গে অপকর্মের ভিডিও ফাঁস করার হুমকি দিয়ে ১৫০ টাকার অলিখিত স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন। ওই স্ট্যাম্প ব্যবহার করে ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট থানা থেকে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন। বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে তাকে বিভিন্ন মামলার আসামি করার হুমকি দেন অভিযুক্তরা।  

২০২০ সালের ১৯ জুলাই ভুক্তভোগী নুর নবী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। এর ভিত্তিতে ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট সেখানে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে নুর নবীকে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য বলা হলে আইনজীবী দুলাল তার ওপর ক্ষিত হয়। পরে নুর নবীকে আইনের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেয় আইনজীবী সমিতির নেতারা।  

২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর ভুক্তভোগী নুর নবী বাদী হয়ে আইনজীবী মনসুর আহম্মদ দুলালকে প্রধান করে তার সহযোগী আনসার উল্যাকে ২য় আসামি করে প্রতারণার মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করেন সদর থানার সে সময়ের পরিদর্শক (তদন্ত) মোসলেহ উদ্দিন। ঘটনার সত্যতা পেয়ে তিনি ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।  

মঙ্গলবার আদালত এ মামলার রায় দেন।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।