কয়েকদিন ধরে ইউক্রেন নিয়ে পুরো পৃথিবী বেশ উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবীর সব দেশ একটি আরেকটির সঙ্গে এমনভাবে সম্পৃক্ত যে, কোনো এক দেশে বড় ধরনের কিছু ঘটলে, সেটি পুরো পৃথিবীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আর সেটি যদি হয় রাশিয়ার মতো পরাশক্তির সঙ্গে ইউক্রেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) আর আমেরিকার, তাহলে সেটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মূল খবর হবে সেটিই স্বাভাবিক।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউক্রেনের যাত্রা শুরু। পূর্ব ইউরোপের এই দেশটি নানা রকম জাতি গোষ্ঠীসমৃদ্ধ। এখানে জাতিগতভাবে যেমন ইউক্রেনিয়ান আছেন, যারা ইউক্রেনের ভাষায় কথা বলেন; ঠিক তেমনি প্রায় ১৮ ভাগ মানুষ জাতিগতভাবে রাশিয়ান। এরা রুশ ভাষায় কথা বলেন। এছাড়া তাতারসহ আরো অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রয়েছে দেশটিতে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ থাকা অবস্থায় তখনকার অনেক পারমাণবিক বোমা এই ইউক্রেনে ছিল। ইউক্রেন স্বাধীন হওয়ার পর তাদের কাছে যে সংখ্যক পারমাণবিক বোমা ছিল, তা যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সম্মিলিত পারমাণবিক বোমের চাইতে বেশি।
তবে ১৯৯২ সালের মে মাসে ‘আর্মড রিডাকশন চুক্তির’ মাধ্যমে তারা সেগুলো আবার রাশিয়ার কাছে ফেরত দেয়।
গত বেশ কয়েকদিন ধরে ইউক্রেনে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছিল। বলা হয়ে থাকে, সেখানকার সরকার ছিল পূর্বপন্থি অর্থাৎ রাশিয়াপন্থি। ইউক্রেনের অবস্থা যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, দেশটির পশ্চিম পাশের বেশির ভাগ মানুষ ইউক্রেনিয়ান ভাষায় কথা বলেন কিংবা জাতিগতভাবে ইউক্রেনিয়ান। আর পূবের বেশির ভাগ মানুষ জাতিগতভাবে রাশিয়ান।
গত বেশ কয়েকদিন ধরেই যারা জাতিগতভাগে ইউক্রেনিয়ান, তারা চাইছিলেন ইইউ এবং আমেরিকাপন্থি সরকার। আর এর ফলেই ওই সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার সরকারপ্রধান নিজের প্রাসাদ ফেলে রাশিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নেন। আর নতুন করে যারা নিজেদের সরকারের অংশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন মাত্র কয়েকদিন আগে; ধরে নেওয়া হয়, তারা পশ্চিমা বা ইইউ ও আমেরিকাপন্থি। কিন্তু, বিপত্তি বাধে ইউক্রেনের ভেতরেই বিশেষ করে যারা পূর্ব ইউক্রেনে থাকেন, তারা এই সরকারকে মেনে নিতে পারেননি। কারণ তারা রাশিয়ার সঙ্গেই সম্পৃক্ত থাকতে চান। বিশেষ করে যখন ক্রিমিয়া প্রদেশের সরকার রাশিয়ার সাহায্য চেয়ে বসে।
ক্রিমিয়া প্রদেশটি ১৯৫৪ সালের আগ পর্যন্ত রাশিয়ার অংশ ছিল এবং সেখানকার প্রায় ৫৮ ভাগের বেশি মানুষ রাশিয়ান বা রাশিয়ান বংশোদ্ভুত। তাই, তারা ইউক্রেনের পশ্চিমপন্থি নতুন সরকারকে মেনে নিতে পারেননি। আর এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পেলাম, রাশিয়ার সংসদ ইউক্রেনে সেনা অভিযান চালাবার অনুমোদন দিলো। যদিও ধারণা করা হচ্ছে, অনুমতির আগেই ক্রিমিয়া প্রদেশে রাশিয়ার সৈন্য প্রবেশ করে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, রাশিয়ার কী লাভ ইউক্রেনে সৈন্য পাঠিয়ে কিংবা কিছু অংশ দখল করে? পশ্চিম ইউরোপের প্রায় বেশির ভাগ দেশের তেল ও গ্যাস সরবরাহের এক তৃতীয়াংশ করে থাকে রাশিয়া। আর সেটি মূলত করা হয়ে থাকে, পাইপ লাইনের মাধ্যমে। আর এই পাইপ লাইনটি ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে গেছে। আসলে পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার সংযোগস্থল হচ্ছে ইউক্রেন। তাই, রাশিয়ার জন্য ইউক্রেন একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। সে কারণে এ অঞ্চলে তাদের আধিপত্য ক্ষুণ্ন হোক, সেটি তারা চাইবে না।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, রুশ নৌবাহিনীর চারটি শাখার একটি (কৃষ্ণসাগর নৌঘাঁটি) ক্রিমিয়ার সেবাস্তোপলে মোতায়েন করা। সামরিক দিক থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ভূমধ্যসাগরে যেতে হলে সেবাস্তোপল দিয়েই যেতে হয় রুশ যুদ্ধজাহাজগুলোকে। আর ন্যাটোর পূর্বমুখী বিস্তার রোধের জন্যও ক্রিমিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার দরকার।
ইউক্রেনের নতুন সরকার পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সখ্য বজায় রাখবে, সেটি ধরেই নেওয়া যায়। কারণ, তারা সে ঘোষণা দিয়েই এসেছে। পশ্চিমা দেশগুলোও তাদের সাহায্য করবে বলে ইউক্রেন ধরে নিয়েছে। কিন্তু, রাশিয়ার মতো বিপুল শক্তিধর দেশের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে যাওয়ার ক্ষমতা বা অপরিণামদর্শিতা যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো বা পশ্চিমা দেশগুলোর কখনোই হবে না।
জর্জিয়ার বিদ্রোহী প্রজাতন্ত্র দক্ষিণ ওশেতিয়া ও আবখাজিয়া দখল করে ২০০৮ সালে তৎকালীন রুশ প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন। সেগুলোকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার সময়ও যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া করার কিছুই ছিল না। এবারও তাই হয়েছে। রুশ বাহিনী একটা গুলিও খরচ না করে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া প্রদেশ দখলে নিয়েছে। তারা এই দখল আর ছাড়বে বলে মনে হয় না।
ইউক্রেন যতই বলুক, রুশ সেনাবাহিনীকে ইউক্রেন ছেড়ে যেতে হবে। কিন্তু, রাশিয়া সেটি কানে তুলবে, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তাই, ইউক্রেন, আমেরিকা, ন্যাটো ও ইইউর সাহায্য চেয়েছে।
রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাতে জড়াবার মতো ক্ষমতা ও কৌশল এ মুহূর্তে কারোরই নেই।
মনে করা হচ্ছে, সামরিক শক্তি দিয়ে অন্তত ইউরোপের এই সব ভূখণ্ডে কোনোভাবেই রাশিয়ার সঙ্গে পারা যাবে না। এমনকী সম্মিলিত শক্তিও হয়ত রাশিয়ার সঙ্গে পেরে উঠবে না। তাই, পশ্চিমা দেশগুলো ভাবছে অর্থনৈতিকভাবে যদি রাশিয়াকে ঘায়েল করা যায়!
রাশিয়া যেহেতু জি-৮ এর সদস্য এবং এর পরবর্তী সম্মেলন রাশিয়ার সোচিতে হওয়ার কথা, তাই তারা ভাবছে রাশিয়াকে বয়কট করা যায় কিনা। কিংবা ইইউতে তাদের ব্যবসা বন্ধ করা যায় কিনা।
তবে সমস্যা হচ্ছে, ইউরোপের অনেক দেশই আসলে জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া রাশিয়া এখন অর্থনৈতিকভাবেও অনেক এগিয়ে গেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যে অবস্থা ছিল, সেখান থেকে তারা অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে। দেশটি এখন অর্থনৈতিকভাবেও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। এ কারণে পশ্চিমা দেশগুলো শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে কিনা তা নিয়ে খোদ আমেরিকাতেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া কোনো রকম রক্তপাত ছাড়াই একটি দেশের একটি প্রদেশ কার্যত তার দখলে বা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে কী হবে, সে নিয়ে ইউরোপের দেশগুলো উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে।
সবার আশঙ্কা যে, পৃথিবী আবার আরেকটি রুশ-মার্কিন ঠাণ্ডা যুদ্ধ দেখতে যাচ্ছে কিনা।
আমিনুল ইসলাম: সহকারী অধ্যাপক, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, tutul_ruk@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ০২১৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০১৪