ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমার একটি ইচ্ছা ছিল বাসন্তীকে দেখব, আমার বাবার রক্ত নিয়ে বাসন্তীদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারলো কিনা। কিন্তু আমার বাবার রক্ত নিয়ে বাসন্তীদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি।
সোমবার (১ আগস্ট) জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন কৃষক লীগের রক্তদান কর্মসূচির উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন।
তিনি বলেন, একটা স্বাধীন রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু যখন সৃষ্টি করেন, তখন সেনাবাহিনীতে যারা মেজর ছিলেন তাদেরকে মেজর জেনারেল পর্যন্ত প্রমোশন দেওয়া হয়। এটাতো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরই দেওয়া ছিল। একজন বাঙালি সাধারণ অফিসার যিনি সেক্রেটারি হতে পারতেন না, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তো সেই কাজ দিয়েছিলেন। অথচ কী দুর্ভাগ্য আমাদের, যাদেরকে সেই মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করলেন, যাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নিজের জীবন যখন উৎসর্গ করলেন, আমরা সন্তানরা পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হলাম। আমার মা সারাটা জীবন যাদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করলেন, সেই বাঙালিদের হাতে আমার বাবা, জীবন মা, ভাইদের জীবন দিতে হলো। এই প্রশ্নের উত্তর কখনো খুঁজে পাইনি। এত বড় বেঈমানি, এত বড় মোনাফেকি কীভাবে করে? আপনাদের মনে আছে ৭৫-এর আগে বারবার অপপ্রচার, কামালকেতো ব্যাংক ডাকাত বানালো, আমার বাবার বিরুদ্ধে বারবার অপপ্রচার, আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, এমনভাবে প্রচার এই প্রচার। শুধু বাংলাদেশে না, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সেই অপপ্রচার চালানো হয়েছে। যেখানে একটি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মানুষের ধারণা ছিল কত কোটি লোক না খেয়ে মারা যাবে, একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ যখন গড়ে তোলেন, গোলায় খাদ্য নেই, যুদ্ধকালীন সময় কোনো ফসল উৎপাদন হয়নি। একটি টাকাও রিজার্ভ ছিল না। সব নোট পুড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। সেই ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে, যেখানে রাস্তাঘাট, স্কুল, ব্রিজ ধ্বংস; সেই অবস্থা থেকে যখন মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু দেশকে এগিয়ে নিয়ে যান। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা পায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তখন সবাই মিলে কাজ করে দেশটাকে গড়ে তোলার পরিবর্তে প্রথম থেকেই শুরু হয় সমালোচনা। নগদ টাকা দিয়ে কেনা খাদ্যের জাহাজ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ পৌঁছাতে দিল না। তখনো আমরা নিজেদের খাদ্য উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করিনি। উত্তরবঙ্গে যে দুর্ভিক্ষ, সেটা তো সারা জীবনই ছিল। দুর্ভিক্ষ যতটা না হয়েছে ,তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে অপপ্রচার।
শেখ হাসিনা বলেন, বাসন্তী নামে একটি মেয়েকে জাল পরিয়ে, ছবি তুলে সারা বিশ্বে প্রচার করা হলো। অথচ সেই সময় ১০-১২ টাকায় একটা শাড়ি পাওয়া যেত। আর একটা মাছ ধরা জালের দাম ১৫০ টাকার নিচে ছিল না। ইত্তেফাকের একজন সাংবাদিক, আর উত্তরবঙ্গের একজন সাংবাদিক তারা দু’জনেই ছবিটি তুলেছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে তারা দু’জনই কিন্তু দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। উত্তরবঙ্গের যে মোনাজাত উদ্দিন, তিনি কিন্তু পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। আর ইত্তেফাকের যিনি ছিলেন, তাকে নিজের গাড়িচালক খুন করেন। এই ছবি দিয়ে অপপ্রচার করা হয়, নানা কথা। সেই সঙ্গে ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী নতুন সংগঠন করে পরিকল্পিতভাবে, এখন থেকে দুই সপ্তাহব্যাপী কী কী অপপ্রচার করা হবে সেটা তৈরি করে সব জায়গায় লোক পাঠিয়ে এই অপপ্রচার চালায়। এটাই ছিল তাদের লক্ষ্য, এটাই ছিল কাজ।
এতকিছুর পরও যখন তারা দেখলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যাবে না, সরানো যাবে না। তার যে জনপ্রিয়তা তা নষ্টের চেষ্টা করেও যখন তারা ব্যর্থ হন, তখন পরিকল্পনা বদলান। যখন জাতির পিতা দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পদক্ষেপ নেওয়ায় ১০ টাকায় উঠে যাওয়া চালের দাম ফের ৩ টাকায় নেমে আসলো; মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মানুষের সব ধরনের অগ্রযাত্রা যখন শুরু হয়; দেশের মানুষের মধ্যে একটা স্বস্তি ফিরে আসে। যখন দেশটা উন্নয়নের সম্ভাবনায় এগিয়ে যাচ্ছিল এবং ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য তিনি সব মহাকুমাকে জেলায় উন্নীত ও জেলাভিত্তিক উন্নয়নের পরিকল্পনা নেন। তখন ঘাতকের দল, বুঝেছিল এটা যদি তিনি বাস্তবায়ন করে যান তাহলে আর কোনদিন তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না। তখনই তারা চরম আঘাত হানলো এই ১৫ আগস্ট।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশের কী উন্নতিটা হয়েছে? জনগণের ভোটের, অধিকার গণতান্ত্রিক অধিকার সেটা কেড়ে নেওয়া হয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল ও মার্শাল ল’ জারি করে দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিল। সব নিয়ম ভঙ্গ করে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান বানিয়েছিল খন্দকার মোস্তাক। যে মোস্তাক ছিল জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারী। তারই দোসর ছিল জিয়াউর রহমান। মোস্তাকের সঙ্গে জিয়া ছিল বলেই তো তাকে সেনাপ্রধান করা হয়েছিল। ইনডেমিনিটি অর্ডিন্যান্স মোস্তাক একটা জারি করে সেটা কিন্তু বাতিল করেছিল। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ইনডেমিনিটিটা আইনে পরিণত করে জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারের হাত থেকে রেহাই দিয়ে তাদেরকে মুক্ত করে পুরস্কৃত করেছিল।
তিনি বলেন, জিয়ার পতনের পর ক্ষমতায় আসলো এরশাদ। একইভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা, একইভাবে দল গঠন, একই প্রক্রিয়া। সেখানে জনগণের কোনো অধিকার ছিল না। জনগণ যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে গেল। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে আমি যখন দেশে ফিরে আসার পর সারা বাংলাদেশটা ঘুরেছি। যে দুর্ভিক্ষের জন্য বাবাকে দোষারোপ করা হয়েছিল, দেশে আসার পর দেখি সেসব জায়গায় প্রতি বছর দুর্ভিক্ষ হয়। আমরা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ছুটে গিয়েছি সহযোগিতা করেছি। আমার একটি ইচ্ছা ছিল যে বাসন্তীকে দেখব। কারণ আমার বাবার রক্ত নিয়ে, আমার মা, ভাইদের রক্ত নিয়ে খুনীরা বাসন্তীদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারলো কিনা। যে অপবাদ দিয়ে ১৫ আগস্ট ঘটনা হলো, দেশের কী পরিবর্তন তারা আনলো- সেটা দেখার ইচ্ছা ছিল বলে আমি সেই চিলমারিতে, কুড়িগ্রামের চিলমারি তিন মাইল কাঁদা পানি ডিঙিয়ে মেঠ পথে হেঁটে আমি সেই বাসন্তীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। দেখলাম বাসন্তী ছেঁড়া কাপড় পড়া, তার মা অসুস্থ, শুয়ে আছে পুরনো একটা চালার নিচে সেটাকে বাড়ি বলা যায় না। মাছি ভনভন করছে, এই অবস্থাতেই আছে তার মা। আমি শুধু বলেছিলাম, আমার বাবার রক্ত নিয়ে তো বাসন্তীদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। তাহলে কেন হত্যা করা হলো? এদেশের মানুষ শোষণ-বঞ্চনার শিকারই থাকলো। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে চোর বানালো, ডাকাত বানালো। এত কিছু তারা করলো, তাহলে দেশের মানুষের জন্য কি করলো? -সেটাই তো বড় প্রশ্ন।
>>> আরও পড়ুন: বিএনপি নেতাদের হাতে হারিকেনই ধরিয়ে দিতে হবে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০২২
এসকে/এমএমজেড