প্রি-পেইড মিটারে মানুষ গ্যাস ব্যবহার করবে পরিমিত। তাই অর্থও সাশ্রয় হচ্ছে বা হবে।
তথ্যমতে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে রাজধানীতে দুই লাখ প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করতে চায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ১৫০ মিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস চুরি রোধ করার পাশাপাশি গ্যাসের অবৈধ সংযোগও বন্ধ করা সম্ভব হবে। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে নতুন পাইপলাইন প্রতিস্থাপন হলে বিভিন্ন ছিদ্র ও ব্যবস্থাপনা ত্রুটির (সিস্টেম লস) কারণে যে অপচয় হয়, তাও রোধ সম্ভব হবে।
কিন্তু প্রি-পেইড মিটারে অগ্রিম রিচার্জ করে গ্যাস ব্যবহার করতে আগ্রহী নন অনেক এলাকার গ্রাহক। গ্রাহক বলছেন, প্রি-পেইড মিটারে অগ্রিম রিচার্জ করলে নানা চার্জ কেটে নেওয়া হয়। এতে লাভবান নয়, উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হন গ্রাহক। প্রি-পেইড নয়, পোস্টপেইড পদ্ধতিতেই থাকতে চান।
তবে ভিন্ন কথা বলছেন তিতাস গ্যাস প্রি-পেইড প্রকল্পের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, গ্যাসের প্রি-পেইড মিটারে গ্রাহক যেমন পরিমিত গ্যাস ব্যবহার করেন, তেমনি খরচও সাশ্রয় হয়। প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করলে অবৈধ গ্যাস সংযোগের সুযোগ থাকে না, তাই এ মিটার স্থাপনে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকজন। তবে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় প্রি-পেইড মিটার স্থাপনে তেমন আপত্তি নেই গ্রাহকদের।
জানা যায়, শুধু সরকারিভাবে প্রি-পেইড মিটার আমদানি নয়, বেসরকারিভাবেও মিটার আমদানি করার সুযোগ দিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় এ গ্যাস ড্রিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। ফলে সব গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনা সম্ভব হবে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গ্যাসের অপচয় রোধ করতে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ৭১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ন্যাচারাল গ্যাস ইফিসিয়েন্সি প্রকল্প (বিডি-পি৭৮) হাতে নেয় তিতাস। প্রথমে প্রকল্পের মেয়াদ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে ডিসেম্বর ২০১৮ ধরা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। সংশোধিত প্রকল্পে ব্যয় কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ৪৯৮ কোটি টাকা। প্রথমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ধরা হলেও বর্তমানে এটি চলমান প্রকল্প হিসেবে অব্যাহত থাকবে।
জাপান সরকাররে ৩৫তম ওডিএ ঋণ প্যাকেজের আওতায় জাইকা ও জিওবির অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এছাড়াও তিতাস গ্যাস ট্রান্সমশিন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিরও অর্থায়ন রয়েছে।
উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুযায়ী বাড্ডা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা সেনানিবাস, মিরপুর, আজমপুর, কাফরুল, খিলক্ষেত, উত্তরখান, দক্ষিণখান, উত্তরা ৩য় পর্ব, পূর্বাচল ও ঝিলমিল এলাকার নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (আরডিপিপি) ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, মহানগর, বনশ্রী, খিলগাঁও, মগবাজার, মালিবাগ, সিদ্বেশ্বরী, শান্তিনগর, ইস্কাটন, কলাবাগান ও হাতিরপুল এলাকা যোগ করা হয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ম্যানুয়াল পদ্ধতির মিটারের চেয়ে প্রিপেইড মিটারে গ্রাহক সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস ব্যবহার করতে পারে। ম্যানুয়াল মিটারে মাসিক বিল কারো ৮শ টাকা এলে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের পরে গ্রাহকের মাসিক খরচ হয় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। মূলত প্রি-পেইড মিটারে অপচয় রোধ হওয়ায় ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ অর্থের সাশ্রয় হয়। ফলে একজন গ্রাহকের প্রতি চুলায় মাসে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা সাশ্রয় হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর অভিজাত এলাকায় প্রিপেইড মিটার স্থাপনে গ্রাহকরা আগ্রহী হলেও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার লোকজন আগ্রহী নয়। প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর অভিজাত এলাকার চেয়ে ঘনবসতি তথা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবাসিক এলাকায় প্রি-পেইড মিটার স্থাপনে জোর দেওয়া হচ্ছে।
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, অভিজাত এলাকার লোকজন সচেতন থাকায় সারাদিন চুলা জ্বালিয়ে অপচয় করে না। কিন্তু মধ্যবিত্ত এলাকার লোকজনের সচেতনার অভাবে সারা দিন চুলা জ্বালিয়ে রেখে অপচয় করে। অভিজাত এলাকায় ২০ শতাংশ অপচয় রোধ হলে নিম্ন বা মধ্যবিত্ত এলাকায় ৫০ শতাংশ অপচয় রোধ হবে। তাই প্রিপেইড মিটার স্থাপনে অভিজাত এলাকার চেয়ে ঘনবসতি তথা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বসবাস যেসব এলাকায়, সেসব এলাকাকে প্রাধান্য দিচ্ছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।
জানা যায়, প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারে প্রাকৃতিক গ্যাসের অপচয় রোধের পাশাপাশি বকেয়া বিল ও বিল পরিশোধের জটিলতা নেই। নির্দিষ্ট মাত্রার ভূমিকম্প হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। মিটারে রিচার্জ করা ক্রেডিট শেষ হয়ে গেলেও তাৎক্ষণিকভাবে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হবে না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে জরুরি ব্যালেন্স দেওয়া হবে, যা পরবর্তী রিচার্জের সময় সমন্বয় করা হবে। প্রিপেমেন্টে পদ্ধতিতে অত্যাধুনকি প্রি-পেইড কার্ড এনএফসি (নিয়ার ফিল্ড কমিশন) ব্যবহারের মাধ্যমে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের নির্দিষ্ট শাখায় ও ইউক্যাশ এজন্টে ব্যাংকিংয়ে সার্বক্ষণিক সেবার আওতায় গ্রাহক সহজে কার্ড রিচার্জ করতে পারবেন।
তথ্যমতে, স্মার্ট প্রি-পেইড মিটারে বিভিন্ন তথ্য মিটারের এলসিডি ডিসপ্লেতে প্রদর্শিত হবে। ফলে একজন গ্রাহক কতুটুকু গ্যাস ব্যবহার করেছেন এবং কতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, তা দেখতে পারবেন। মিটারে একটি নিয়ন্ত্রক বাল্ব রয়েছে, যা গ্যাস সরবরাহ স্বয়ংক্রয়িভাবে চালু বা বন্ধ করতে পারে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, প্রি-পেইড মিটার স্থাপনে প্রাথমিক পর্যায়ে অধিকাংশ গ্রাহক মিটার গ্রহণে অনাগ্রহী থাকায় গ্রাহক জরিপ সম্পাদনে ও মিটার স্থাপনে সহযোগিতা করেনি। তাই নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ফলে ২০১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেড় বছরে মাত্র ৬১ হাজার ১৩৮টি মিটার স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। তাই গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে চাহিদা অনুযায়ী কিচেনে মিটার স্থাপন ও জনসচেতনতা বাড়ানোয় গুরুত্ব দিচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রি-পেইড মিটার সর্ম্পকে রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা মেরাজুল ইসলাম বলেন, প্রি-পেইড মিটারে নানা গোপন চার্জ জুড়ে দেওয়া হয়। এতে পোস্টপেইডের চেয়ে প্রি-পেইডে খরচ বেশি হয়। ফলে এ মিটার স্থাপনে আগ্রহ নেই গ্রাহকদের। যদি কোনো ধরনের চার্জ কেটে নেওয়া হবে না সেটা যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে গ্রাহক হয়তো সেটি গ্রহণ করবে।
তবে প্রি-পেইড মিটারে কোনো ধরনের গোপন চার্জ নেই বলে জানিয়েছেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির প্রি-পেইড মিটার স্থপন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী ফয়জার রহমান। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রি-পেইড মিটার ব্যবহার গ্রাহক ও কোম্পানি উভয়ের জন্য লাভজনক। তাই এটি চলমান থাকা দরকার।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৫ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৯
টিএম/এএ