রাঙামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ি উপজেলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন মো. শফিক। পেশায় ট্রাক্টর চালক।
সড়কে, নালা-নর্দমায়, ঘরের আশপাশ, সবখানে পরিবেশ দূষণ করছে পলিথিন। হঠাৎ তার মাথায় এলো এ পলিথিনকে কোনো কাজে লাগানো যায় কিনা। যে চিন্তা সেই কাজ। ইন্টারনেটে খোঁজাখুজি শুরু। পেয়ে গেলেন তার কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন বুননের রহস্য। তিনি দেখলেন, চীনা মানুষেরা পরিত্যাক্ত পলিথিন এবং পরিত্যাক্ত প্লাস্টিকের কৌটা নিয়ে বিভিন্ন রকমের ঘরের শোপিসসহ নানা রকম সৌন্দর্যমণ্ডিত আসবাবপত্র তৈরি করছে। এরপর তিনি নিজে সিদ্ধান্ত নিলেন, পরিত্যাক্ত পলিথিন দিয়েই জ্বালানি তেল উৎপন্ন করবেন।
স্ত্রীর কানের দুল এবং নিজের শেষ সম্বল (জমানো টাকা) নিয়ে উপজেলার মাস্টার পাড়া গ্রামের পুরাতন মারিশ্যা জামে মসজিদের এক শতক জায়গা ভাড়া নিয়ে নিজের স্বপ্ন বুননের কাজ শুরু করে দিলেন।
কাচাঁমাল হিসেবে পরিত্যাক্ত পলিথিন, নানা রকম প্লাস্টিকের কৌটা সংগ্রহ শুরু করলেন। জ্বালানি হিসেবে লাকড়ি এবং তেল উৎপাদনের প্রাথমিক যন্ত্রপাতি কিনলেন। এ প্রকল্পটি করতে প্রায় লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান শফিক।
এইবার সেই মানুষটার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমার ছোট্ট সংসার। ছেলে একটি সরকারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে, আর মেয়ের বয়স পাঁচ মাস। স্ত্রী গৃহিণী। মানুষের ট্রাক্টর চালিয়ে মাসে ১০ হাজার টাকার মতো আয় করে কোনোরকমে সংসার চালাই। কিন্তু নিজের জীবনে একটা স্বপ্ন ছিল। কোনো কিছু একটা আবিষ্কার করার। কিন্তু কী আবিষ্কার করবো তা কখনো ভাবিনি। ‘লেখাপড়া না জানায় কোনো পেপার-পত্রিকা পড়তে পারি না। তাই একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনই আমার বিনোদনের সঙ্গী। ’শফিক আরও বলেন, পথে হাঁটার সময় প্রায়ই খেয়াল করতাম পলিথিন আমাদের পরিবেশকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। টিভিতেও দেখেছি। চলতি বছরের মাস তিনেক আগে মাথায় এলো পলিথিনকে কোনো কাজে লাগানো যায় কিনা। সেই ভাবনা থেকেই মূলত পরিকল্পনা মতো কাজে নেমে পড়ি।
প্রকল্পটি করতে কী পরিমাণ টাকা লেগেছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার প্রায় এক লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। অনেক কষ্ট করে, ঝুঁকি এবং জীবনের শেষ সম্বল দিয়ে এ প্রকল্পটি দাঁড় করিয়েছি। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কেনার টাকা নেই। নিজের মেধা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে কাজ করছি।
তিনি বলেন, আমি অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল তৈরি করছি। বিশুদ্ধকরণ যন্ত্রপাতি কিনতে না পারায় কেরোসিন তৈরি করা এবং গ্যাস সরবরাহ করার পাত্র না থাকায় গ্যাস সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি এ প্রকল্পটি থেকে ছাপার কাজে ব্যবহারের জন্য কালিও উৎপন্ন করা হচ্ছে।
প্রতি লিটার অকেটন ৫৫ টাকা, পেট্রোল ৭০ টাকা, ডিজেল ৫৫ টাকা এবং কেরোসিন ৫৫ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, এক কেজি পলিথিন পুড়িয়ে ৭০০ গ্রাম তেল উৎপন্ন করা যাচ্ছে। এছাড়া ছাপা কালি কেজিপ্রতি ২৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। এসব জ্বালানি তেল উৎপন্ন করতে কোনো বিদ্যুৎ লাগে না। শুধু আগুনের সাহায্যেই এসব কিছু তৈরি করা হচ্ছে।
শফিক বলেন, আমি প্রতিদিন ৩০ লিটার জ্বালানি তেল উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়েছি। স্থানীয় ব্যক্তিরা আমার উৎপাদিত তেল ব্যবহার করে তাদের পরিবহন চালাচ্ছে। দেখে খুব খুশি লাগছে।
সম্প্রতি উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তার প্রকল্পটি পরিদর্শন করে গেছেন এবং তাকে সহযোগিতার করবেন বলেও তাকে আশ্বস্ত করেছেন। নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি এ প্রকল্পটিকে আরও বড় পরিসরে তৈরি করতে চাই। এজন্য অনেক যন্ত্রপাতি দরকার। তাহলে গ্যাস এবং বিশুদ্ধকরণ সাদা কেরোসিনও সরবরাহ করতে পারবো।
‘আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো গেলে দুর্গম এ উপজেলায় একটি কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে এবং অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। এজন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করি। সরকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে আমার প্রকল্পটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে,’ যোগ করেন তিনি।
স্থানীয় সংবাদকর্মী আবু নাছের বাংলানিউজকে বলেন, একজন নিরক্ষর ব্যক্তির এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেখে আমরা বিস্মিত-হতবাক। নিজের মোটরসাইকেল চালানোর জন্য শফিকের উৎপাদিত জ্বালানি তেল ব্যবহারের কথাও জানান এ সংবাদকর্মী।
বাঘাইছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইএনও) আহসান হাবীব জিতু বাংলানিউজকে বলেন, শফিকের জ্বালানি তেলের উদ্ভাবনী প্রকল্পটি দেখলাম। অনেক চালকরা তার উৎপাদিত তেল ব্যবহার করে গাড়ি চালাচ্ছেন। প্রকল্পটি দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। এখন তার প্রকল্পটি পরিবেশগত কোনো ক্ষতির কারণ হবে কিনা, খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।
যদি পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়, তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রকল্পটির উন্নয়নে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে বলে জানান ইউএনও।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৯
এসএ/