ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপার মহিমার রমজান

‘তারাবিতে আজ পাঠ করা হবে’

ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকার শিক্ষা

মুফতি মাহফুযূল হক, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৫ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৫
ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকার শিক্ষা

আজ বুধবার। চলছে মাহে রমজানের প্রথম দশক, রহমতের দশক।

তারাবির হিসাবে আজ অনুষ্ঠিত হবে ৭ম তারাবি। আজকের খতমে তারাবিতে পবিত্র কোরআনে কারিমের ১০ম পারা পূর্ণ তেলাওয়াত করা হবে। আজকে তেলাওয়াত শুরু হবে সূরা আনফালের ৪১নং আয়াত থেকে। সূরা আনফাল শেষ করে সূরা তওবা শুরু করে ৯৩নং আয়াত পর্যন্ত তেলাওয়াত করা হবে।

আজকের তেলাওয়াতের উল্লেখযোগ্য বিষয়
সূরা আনফালের ৪১-৭৫নং আয়াতে বদর যুদ্ধ, যুদ্ধবন্দী, গণিমতসহ যুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা স্থান পেয়েছে। পাশাপাশি জিহাদের জন্য মুমিনদের উৎসাহিত করা হয়েছে।

সূরা তওবা
সূরা তওবার আরেক নাম বারাআত। এটা একটি মাদানি সূরা। এ সূরার মোট আয়াত ১২৯টি। আজ তারাবিতে তেলাওয়াত করা হবে শুরু থেকে ৯৩নং আয়াত পর্যন্ত।

আরবি তওবা অর্থ ক্ষমা। এই সূরাকে সূরা তওবা বলার কারণ হলো, এই সূরার মুসলমানদের তওবা কবুল হওয়ার বর্ণনা রয়েছে। সূরাটির অন্য নাম হলো বারাআত। বারাআত নামকরণের কারণ হলো, এই সূরায় অবিশ্বাসীদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ও তাদের ব্যাপারে দায়িত্ব মুক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এই সূরার বৈশিষ্ট্য হলো, এর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লেখা হয় না ও পাঠ করা হয় না। সূরা তওবার সর্বত্র কিছু যুদ্ধ (মক্কা বিজয়, হোনাইন যুদ্ধ, তাবুক যুদ্ধ), যুদ্ধ সংক্রান্ত ঘটনাবলী এবং এ সংক্রান্ত হুকুম, মাসায়েল ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে। এ সব যুদ্ধের প্রেক্ষিতে আরবের সকল গোত্রের সঙ্গে সব ধরনের চুক্তি বাতিলের নির্দেশ আসে।

এ সূরাটি মূলতঃ তিনটি ভাষণের সমষ্টি । প্রথম ভাষণটি সূরার প্রথম থেকে শুরু হয়ে পঞ্চম রুকুর শেষ অবধি। নাজিলের সময় হচ্ছে ৯ হিজরির জিলকদ মাস বা তার কাছাকাছি সময়। নবী (সা.) সে বছর হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) কে আমিরুল হজ নিযুক্ত করে মক্কায় রওয়ানা করে দিয়েছিলেন। এমন সময় এ ভাষণটি নাজিল হয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে হজরত আলী (রা.) কে তার পেছনে পাঠিয়ে দেন। যাতে হজের সময় সারা আরবের প্রতিনিধিত্বশীল সমাবেশে অবতরণকৃত কোরআনের বিষয়াবলী পাঠ করে শুনানো হয় এবং সে অনুযায়ী কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করা যায়।

দ্বিতীয় ভাষণটি ৬ রুকুর শুরু থেকে ৯ রুকুর শেষ পর্যন্ত। এ অংশটুকু ৯ হিজরির রজব মাসে বা তার কিছু আগে নাজিল হয়। সে সময় নবী করিম (সা.) তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এখানে মুমিনদেরকে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে । আর যারা মুনাফেকি, দূর্বল ঈমান অথবা কুড়েমি ও অলসতার কারণে আল্লাহর পথে ধনপ্রাণের ক্ষতি বরদাশত করার ব্যাপারে টালবাহানা করছিল তাদেরকে কঠোর ভাষায় তিরষ্কার করা হয়েছে।

তৃতীয় ভাষণটি ১০ রুকু থেকে শুরু হয়ে সূরার শেষ পর্যন্ত। তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর এ অংশটি নাজিল হয়। এখানে এমন অনেকগুলো খণ্ডিত বিষয় রয়েছে যেগুলো ওই দিনগুলোতে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ও পরিবেশের কারণে নাজিল হয়; পরে নবী করিম (সা.) আল্লাহর হুকুমে সেগুলো সব একত্র করে একই ধারাবাহিক ভাষণের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেন। কিন্তু যেহেতু সেগুলো একই বিষয়বস্তু ও একই ঘটনাবলীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাই ভাষণের ধারাবাহিকতা কোথাও ব্যাহত হতে দেখা যায় না। এখানে মুনাফিকদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। তাবুক যুদ্ধে যারা পেছনে রয়ে গিয়েছিলেন তাদেরকে ভৎর্সনা ও তিরস্কার করা হয়েছে। আর যে সাচ্চা ঈমানদার, নিজেদের ঈমানের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান ছিলেন; কিন্তু আল্লাহর পথে জিহাদে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিলেন তিরস্কার করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ক্ষমার কথাও ঘোষণা করা হয়েছে।

সূরা নাজিলের পটভূমি
এ সূরার বিষয়বস্তুর সঙ্গে যে ঘটনা পরম্পরার সম্পর্ক রয়েছে, তার সূত্রপাত ঘটেছে মূলতঃ হোদাইবিয়ার সন্ধি থেকে। হোদাবিয়া পর্যন্ত ছ’বছরের অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের ফলে আরবের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ এলাকায় ইসলাম একটি সুসংঘটিত ও সংঘবদ্ধ সমাজের ধর্ম, একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

হোদায়বিয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর ইসলাম আরো বেশি নিরাপদ পরিবেশে চারদিকে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পায়। এরপর ঘটনার গতিধারা দু’টি বড় বড় খাতে প্রবাহিত হয়। আরো সামনে অগ্রসর হয়ে ওই দু’টি খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে একটির সম্পর্ক ছিল আরবের সঙ্গে, অন্যটি রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে।

সূরা তওবার বিষয়াবলী
৬ষ্ঠ হিজরিতে হুদাইবিয়া নামক স্থানে কোরাইশ এবং নবী করিম (সা.)-এর মাঝে একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধবিরতিমূলক শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তি মোতাবেক উভয় পক্ষের মিত্রদের জন্য এ চুক্তি প্রযোজ্য ছিল। বনু খুজয়া ছিল মুসলমানদের মিত্র। আর বনু বকর ছিল কোরাইশদের মিত্র। চুক্তির কিছু দিন পর কোরাইশদের মিত্র বনু বকর মুসলমানদের মিত্র বনু খুজয়ার ওপর আক্রমণ করে বসে।

চুক্তি মোতাবেক কোরাইশ পক্ষ তাদের মিত্রদের এ আক্রমণ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে বাধ্য ছিল। কিন্তু তারা তা করে নাই। বরং চুক্তি লংঘন করে নিজেদের মিত্র বনু বকরকে অস্ত্র ও যুদ্ধের বিভিন্ন রসদ সরবরাহ করে মুসলিম মিত্র বনু খুজয়ার ওপর আক্রমণে সহযোগিতা করে। তাদের এ চুক্তি লংঘনের প্রতিশোধ নিতে মহানবী (সা.) ৮ম হিজরিতে মক্কা অভিযান পরিচালনা করে মক্কা বিজয় করেন।

তৎকালে মদিনার বিভিন্ন গোত্র ছাড়াও আরবের অনেকগুলো গোত্রের সঙ্গে মুসলমানদের বিভিন্ন মেয়াদের বিভিন্ন শর্তের শান্তিচুক্তি ছিল। ৯ম হিজরিতে সূরা তওবা অবতীর্ণ হয়। এ সূরার বিভিন্ন আয়াতে আরবের বিভিন্ন গোত্রের চুক্তি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়। কাউকে চারমাসের সময় দেয়া হয়। কাউকে পূর্বের মেয়াদ পূরণের সুযোগ দেয়া হয়। এভাবে এ সূরার মাধ্যমে গোটা আরব উপদ্বীপে বসবাসকারী সকল গোত্রের সামনে ইসলামের অধীনতা স্বীকার করার চূড়ান্ত বার্তা ঘোষণা করা হয়। ৯ম হিজরিতে অনুষ্ঠিত হজে হজরত আলী (রা.) এসব বিষয়ে সবাইকে অবগত করান। যে বিষয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

১৮নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে আল্লাহর মসজিদসমূহের যথার্থ খেদমত তারাই করতে পারে, যারা আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান রাখে। গুরুত্বের সঙ্গে সুন্দরভাবে নামাজ আদায়া করে, জাকাত প্রদান করে ও আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করে না।

২৫-২৬নং আয়াতে হুনাইনের যুদ্ধের আলোচনা করা হয়েছে। ৮ম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর পর হাওয়াজিন ও সাকিফ গোত্রের সঙ্গে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে মুসলিম সৈন্য ছিল ১২হাজার। ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত কোনো জিহাদে এত বিপুল সংখ্যক মুসলিম সৈন্য সমবেত হয়নি। কিন্তু তার পরও প্রথমদিকে মুসলিম বাহিনী চরম বিপর্যয়ের শিকার হয়। ময়দানে মুসলিম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা অনেক কমে আসে। শেষ পর্যায়ে আল্লাহর খাস মেহেরবানিতে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে।

বস্তুত এভাবে আল্লাহতায়ালা প্রমাণ করে দেখান যে, মুসলিম বাহিনী কখনো সৈন্য সংখ্যা দিয়ে বিজয় লাভ করে না। জাগতিক উপকরণ দিয়ে তারা বিজয় লাভ করে না। তারা বিজয় লাভ করে আল্লাহর রহমতে।

৬০নং আয়াতে জাকাতসহ সকল ওয়াজিব দানের খাত উল্লেখ করা হয়েছে। ওই খাতগুলো হলো- নিঃস্ব, অভাবগ্রস্থ, ইসলামি রাষ্ট্রের জাকাত বিভাগের কর্মচারী, দুর্বল নও মুসলিম, দাসমুক্ত করা, ঋণগ্রস্থ, আল্লাহর দ্বীনের জন্য জিহাদকারী ও অভিবাসী।

৭৩নং আয়াত থেকে তাবুক যুদ্ধের আলোচনা শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘন্টা, জুন ২৪, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।