শুধু দৈহিক চাহিদা পূরণ থেকে সংযমী হলেই সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয় না। সিয়ামের পূর্ণতার প্রধান উপাদান হচ্ছে পাপাচার থেকে বিরত থাকা।
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, রোজা রেখে যে ব্যক্তি মিথ্যাচার ও অন্যায় আচরণ পরিহার করলো না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ এমন রোজা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় নয়। সুতরাং পবিত্র রমজানের সিয়াম সাধনার পূর্ণাঙ্গ সুফল পেতে হলে অন্যায় কার্যকলাপ থেকেও বিরত থাকতে হবে।
হাদিসটির আলোকে রোজার জন্য পানাহারের সঙ্গে গুনাহের কাজগুলো বর্জনের গুরুত্ব পরিষ্কার হয়। পাপাচার বর্জন করতে না পারলে রোজা রাখা অর্থহীন হয়ে যায়। কিন্তু যার জন্য পাপাচার বর্জন সম্ভব হয় না, কিংবা যে ব্যক্তি রোজা রেখেও অন্যায় কাজ করে, তাকে কী পরামর্শ দেওয়া যায়?
তার রোজার পরিণতি কী হবে? যেমন গিবত বা পরচর্চা একটি পাপাচার। কোরআন মজিদে এটিকে মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য বলা হয়েছে। কোনো রোজাদার যদি গিবতের পাপে লিপ্ত হয়, তাহলে তার রোজা নষ্ট হয়ে যাবে কী? প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ফকিহ আধ্যাত্মিক সাধক হজরত সুফিয়ান সওরী (রহ.) এর অভিমত ছিল, গিবতের কারণে রোজা নষ্ট হয়ে যায়। তেমনি ইমাম গাজ্জালি (রহ.) তার অমর গ্রন্থ ‘এহইয়া উলুমুদ্দীনে’ প্রসিদ্ধ তাবেয়ি হজরত মুজাহিদ ও হজরত ইবনে শিরিনের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন, গিবত রোজা নষ্ট হওয়ার কারণ।
এসব মনীষী প্রথমত, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিস দলিল হিসেবে উল্লেখ করেন। দ্বিতীয়ত, তারা যুক্তি দেন, পানাহার মৌলিকভাবে হালাল। অথচ রোজার কারণে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মিথ্যাচার, গিবত প্রভৃতি কখনও বৈধ নয়। রোজায় এসবের কদর্যতা আরও বেড়ে যায়।
রোজা রেখে এগুলোতে লিপ্ত হওয়া আরও গুরুতর অন্যায়। সুতরাং মৌলিকভাবে হালাল ও বৈধ পানাহার যদি রোজা নষ্টের কারণ হয়, তা হলে যেসব কাজ কোনো অবস্থাতেই বৈধ নয়, তাতে লিপ্ত হওয়ার কারণে রোজা নষ্ট হওয়া খুবই যুক্তিসঙ্গত।
অন্যান্য মনীষী এ যুক্তি গুরুত্ব স্বীকার করেও আইনের ক্ষেত্রে সাবধানী মন্তব্য করার মূলনীতি অনুসারে বলতে চান, অন্যায় কর্ম ও পাপাচারের কারণে সিয়াম সাধনার সুফল কমে যায়। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রোজা নষ্ট হয়ে যাওয়ার রায় দেওয়া সমীচীন হবে না। হাকিমুল উম্মত হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) এ ব্যাপারে একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, রোজার একটি কাঠামোগত স্বরূপ রয়েছে। তেমনি রয়েছে একটি উদ্দেশ্যগত স্বরূপ। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে পানাহার ও কামাচার বর্জন রোজার কাঠামোগত স্বরূপ। সেই মতে রোজায় পানাহার যদিও লঘু অন্যায়; কিন্তু তা কাঠামোগত স্বরূপের পরিপন্থি। আর পাপাচার যদিও গুরুতর অন্যায়। কিন্তু তা রোজার কাঠামোগত স্বরূপের পরিপন্থি নয়। রোজার উদ্দেশ্যগত স্বরূপ হলো পানাহারের পাশাপাশি পাপাচার বর্জন করা।
সুতরাং গুনাহের কাজ রোজার উদ্দেশ্যগত স্বরূপের বিরোধী। তাই অন্যায় কাজ ও আচরণের কারণে রোজার উল্লেখযোগ্য সুফল থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে। উল্লেখযোগ্য বলা হলো এ কারণে যে, এ ধরনের রোজাও অর্থহীন নয়।
কেয়ামতের দিন তাকে এ মর্মে প্রশ্ন করা হবে না যে, সে কেন রোজা রাখেনি। বরং প্রশ্ন করা হবে, রোজা কেন ত্রুটিপূর্ণ করে রেখেছে। অতএব এমন বিভ্রান্তিতে পড়া যাবে না যে, পাপাচার বর্জনে অক্ষম ব্যক্তির রোজা রাখা অনর্থক। শরিয়তের অন্যান্য ইবাদতের বেলায়ও একই নিয়ম প্রযোজ্য। সালাত আদায়ের জন্য একাগ্রচিত্ত হওয়া জরুরি।
নিজের পুরো সত্তা যখন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সমীপে নিবেদনের অনুভূতি নিয়ে কেউ সালাতে মশগুল হয়, তখন তার প্রতি বর্ষিত হতে থাকে আল্লাহর বিশেষ রহমতের ধারা। আর এটিই কাম্য।
ইহসান কাকে বলে হজরত জিবরাইল আলাইহিস সাল্লামের এ প্রশ্নের জবাবে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে যেন তাকে প্রত্যক্ষ করছো। যদি তুমি তাকে প্রত্যক্ষ করার মনোভাব আনতে না পারো, তা হলে ভাববে তিনি তোমাকে প্রত্যক্ষ করছেন। কিন্তু কারো পক্ষে এমন মনোভাব সৃষ্টি সম্ভব না হলে তাকেও সালাত আদায় থেকে বিরত থাকার অনুমতি দেওয়া যায় না।
তেমনি পাপাচার ছাড়তে না পারলেও রোজা রেখে যেতে হবে। কেননা এতেও আল্লাহর হুকুম নামমাত্র হলেও পালন করা হবে। আর শরিয়তের প্রতিটি ইবাদতের রয়েছে বিশেষ কল্যাণ ও প্রভাব। এভাবে রোজা রাখতে রাখতে একসময় তার মধ্যে পাপাচার বর্জনের প্রেরণা জাগতে পারে।
লেখক: মুফাসসিরে কুরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।
চেয়ারম্যান: বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি।
বাংলাদেশ সময়: ০২৫৩ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৮
এমএ/