ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপার মহিমার রমজান

আধুনিক স্থাপত্যকে হার মানাচ্ছে ষাট গম্বুজ মসজিদ!

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০২২
আধুনিক স্থাপত্যকে হার মানাচ্ছে ষাট গম্বুজ মসজিদ!

বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে ফিরে: প্রাচীন সৌন্দর্যের স্থাপত্য নিদর্শন হচ্ছে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ। হযরত খান জাহান আলী (রঃ) এর নির্মিত অপূর্ব কারুকার্য খচিত পাঁচ শতাব্দীরও অধিক কালের পুরাতন এ মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।

ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদের নির্মাণশৈলী আর সৌন্দর্য নজর কাড়ে সবার। আধুনিক স্থাপত্যকে হার মানাচ্ছে প্রাচীন সৌন্দর্যমণ্ডিত ষাট গম্বুজ মসজিদ। তাই মসজিদটি দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ মসজিদটি দেখতে আসেন।

ষাট গম্বুজ মসজিদে ৮১টি গম্বুজ: স্থাপত্য কৌশলে ও লাল পোড়া মাটির ওপর লতাপাতার অলংকরণে মধ্য যুগীয় স্থাপত্য শিল্পে এ মসজিদ এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। যদিও এটি ষাটগম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিত, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে চতুষ্কোণের বুরম্নজের ওপর চারটি গম্বুজসহ এতে মোট ৭৪টি গম্বুজ আছে এবং মধ্য সারির বাংলা চালের অনুরূপ ৭টি চৌচালা গম্বুজসহ এতে মোট ৮১টি গম্বুজ আছে। মসজিদটির প্রার্থনা কক্ষের চৌচালা ছাদ ও গম্বুজগুলো ইট ও পাথরের ষাটটি খাম্বার দ্বারা সমর্থিত খিলানের ওপর নির্মিত।

বাগেরহাট শহরের সাত কিলোমিটার পশ্চিমে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কের উত্তর পাশে সুন্দরঘোনা গ্রামে ষাটগম্বুজ মসজিদের অবস্থান।

মসজিদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাগেরহাট জেলার উপকূলে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনে খান জাহান আলী নামে এক সাধু একটি মুসলিম উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে একটি সমৃদ্ধ নগরীতে সাধু সংঘ সম্পর্কে প্রচার করেছিলেন, তত দিনে খাঁন জাহান আলী এই শহরটি এক ডজনেরও বেশি মসজিদ দিয়ে সজ্জিত করেছিলেন। ধারণা করা হয় তিনি ১৫শ শতাব্দীতে শৈ-গুম্বাদ মসজিদ নামে পরিচিত এই মসজিদটি বহু বছর ধরে ও বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করেছিলেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৩৩ সালে ব্রিটিশরা এবং পরে পাকিস্তান সরকার এই মসজিদটি প্রথমে মেরামত করেছিল। ২০১৪ সালে দক্ষিণ এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এটি আবার মেরামত করা হয়েছিল এবং বাগেরহাটের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৫ সালে মসজিদটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে পরিণত হয়েছিল।

ষাটগম্বুজ মসজিদের নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, সংস্কৃত শব্দ ‘সাত’ ও ফারসি শব্দ ‘ছাদ’ এর উপর গম্বুজ থাকায় এটি ‘ছাদগম্বুজ’ থেকে ষাটগম্বুজ হয়েছে। আবার অনেকের মতে, মসজিদের অভ্যন্তরে ছয়টি সারিতে ১০টি করে মোট ৬০টি পাথরের খাম্বার উপর মসজিদের ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ।

আবার কারও মতে মসজিদটির ছাদ সমতল নয়। এটি গুম্বজ আকৃতির। অর্থাৎ ছাদে গুম্বজ। যার থেকে মসজিদটি ‘ছাদগুম্বুজ‘ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরে কথ্যরূপে ‘ষাটগম্বুজ‘ নাম হয়েছে। জনশ্রুতি আছে যে, হযরত খান জাহান আলী (রহঃ) ষাট-গম্বুজ মসজিদ নির্মাণের জন্য সমূদয় পাথর চট্টগ্রাম আবার কারও মতে ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে অলৌকিক ক্ষমতা বলে জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন। পুরো মসজিদ তৈরির মূল উপাদান চুন, সুরকি, কালোপাথর ও ছোট ইট। এই মসজিদের স্থাপত্যকলার সঙ্গে মধ্য এশিয়ার তুঘলক (তুরস্ক) স্থাপত্য শৈলীর মিল রয়েছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

রমজানে বাড়ে মুসল্লিদের ভিড়: রমজান মাসে বিপুলসংখ্যক মুসল্লি ইবাদত-বন্দেগির উদ্দেশ্যে এ মসজিদে আগমন করে থাকেন। দেশের অন্যতম একটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ বেশ প্রসিদ্ধ। সারা বছর এখানে পর্যটকদের আনাগোনা থাকে চোখে পড়ার মতো।

ষাটগম্বুজ মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা মো. হেলাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, দুই জন হাফেজ খতম তারাবি পড়াচ্ছেন। দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিারা ষাটগম্বুজ মসজিদে নামাজ পড়তে আসছেন। শুক্রবার মুসল্লিতে ভরে যায়। মসজিদের মধ্যে ১৫শ’ থেকে ১৮শ’ লোক একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। এছাড়া বাইরেও পড়েন অনেকে। মসজিদ, জাদুঘরে ও ঘোড়া দীঘিতে ঘুরতে ২০ টাকা ফি লাগে। তবে আজান থেকে নামাজের সময় পর্যন্ত উত্তর পাশের একটি গেট খোলা থাকে। সেখান থেকে মুসল্লিরা নামাজের জন্য আসেন। তাদের প্রবেশ ফি লাগে না।

মুগ্ধ পর্যটকরা: ষাটগম্বুজ মসজিদের সৌন্দর্য ভ্রমণ পিপাসুদের মুগ্ধ করে আসছে। চলতি বছরের ২২ মার্চ (মঙ্গলবার) সুন্দরবন ও ষাটগম্বুজ মসজিদ ভ্রমণ করেছেন বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীসহ ১৫ দেশের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিরা।

প্রতিনিধি দলে ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, ইতালি, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, নেপাল, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও দুটি সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন আয়োজিত মুজিব ফ্যামিলাইজেশন ট্যুরের অংশ হিসেবে তারা পর্যটন এলাকা ঘুরতে আসেন।

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ভ্রমণ শেষে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ ও বাগেরহাট যাদুঘর ঘুরে দেখেন। তারা সবাই মসজিদ ও জাদুঘরের অসাধারণ স্থাপত্য শৈলী দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।

সম্প্রতি ষাটগম্বুজ মসজিদে ঘুরতে আসা খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) তিন শিক্ষার্থী আবরার তাসনিম ওয়াসি, কিশোর কান্তি দাস ও আব্দুর রহিম হৃদয় বলেন, এ মসজিদের অসাধারণ স্থাপত্য শৈলী দেখে আমরা সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। এই মসজিদের স্বতন্ত্র স্থাপত্য শৈলী এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় এটি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণ। ১৫ শতকের দিকে খান জাহান (রহ.) অতুলনীয় নকশায় মসজিদটি স্থাপন করেছেন। সেই আমলে এত নান্দনিক নির্মাণ শৈলী যা দেখে আমরা অবাক হয়েছি। আধুনিক স্থাপত্যকে হার মানাচ্ছে ষাট গম্বুজ মসজিদ।

যেভাবে আসতে পারেন ষাটগম্বুজ মসজিদে: ঢাকার গাবতলী ও সায়দাবাদ থেকে বাসে সরাসরি বাগেরহাট আসা যায়। এছাড়া কমলাপুর থেকে ট্রেনে খুলনা হয়ে বাগেরহাট আসা যায়। অথবা বিমান যোগে যশোর নেমেও খুলনা হয়ে বাগেরহাটে আসা যায়।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১১ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০২২
এমআরএম/এনএইচআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।