রমজান মাস মুমিনের জীবনের সেরা মাস। রমজান মাসকে কোরআনের বসন্তকাল বলা হয়, কারণ এ মাসেই কোরআন নাযিল হয়েছে এবং হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেয়তর রাত্রি শবে কদর এ মাসেই বিদ্যমান এবং সর্বোপরি রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস পবিত্র রমজান।
রমজান মাসের প্রতিটি ক্ষণ মানুষের আমলের সেরা সময়। আনুগত্য ও নেকি বৃদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সকাশে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মাস। আল্লাহর সমীপে নিজেকে সৌভাগ্যবান করে নেওয়ার মাস। অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজান মাসে সর্বপ্রকার ইবাদতের ফজিলত অনেক বেশি। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এই মাসের অসংখ্য ফজিলত ও মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে।
কুরআন অবতীর্ণের মাস: রমজান মাসেই পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রমজান মাস, যে মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা আদ্যোপান্ত হিদায়াত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে, সে যেন এ সময় অবশ্যই রোজা রাখে। ’ (সূরা বাকারা-১৮৫)।
লাইলাতুল কদরের মাস: রমজান মাসেই লাইলাতুল কদর লাভ হয়। আল্লাহতায়ালা রমজান মাসের ফজিলত বৃদ্ধি করেছেন লাইলাতুল কদরের মাধ্যমে। এই রাতে মানুষের পাপসমূহ ক্ষমা করা হয়। সওয়াব বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি এটা (কুরআন) শবে কদরে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো শবে কদর কী? শবে কদর এক হাজার মাস অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়। সে রাত আদ্যোপান্ত শান্তি-ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত। ’ (সূরা কদর : ১-৫)।
জাহান্নামের দরজা বন্ধ করার মাস: নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাস আগমন করলে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদেরকে বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়। ’ (মুসলিম-১০৭৯)।
জাহান্নামিদের মুক্তিদানের মাস: আবু সাইদ খুদরি রা: বলেন, নবী সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসের প্রতিদিন ও রাতে জাহান্নামিদের মুক্তি দেন। রমজানের প্রতিদিন ও রাতে মুসলমানের দোয়া কবুল করা হয়। ’ (মুসনাদে আহমদ-৬৬৪)।
গোনাহসমূহের কাফফারার মাস: অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা কবিরা গোনাহে লিপ্ত না হলে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে অন্য জুমা এবং এক রমজান থেকে অন্য রমজান তার মধ্যবর্তী গোনাহসমূহের কাফফারা হয়ে যায়। ’ (মুসলিম-২৩৩)।
গোনাহ মাফ হওয়ার মাস: অপর একটি হাদিসে এসেছে, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজান মাসে রোজা পালন করবে, তার পেছনের সমস্ত গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবে আশায় লাইলাতুল কদরে ইবাদত করবে, তারও পেছনের সমস্ত গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। ’ (বুখারি-২০১৪)।
জান্নাতে লাভের মাস: জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা: বলেন, ‘এক ব্যক্তি নবী করিমকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, যদি আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি, রমজান মাসে রোজা পালন করি, হালালকে হালাল মনে করি, হারামকে হারাম জ্ঞান করি এবং এসবে কোনো বৃদ্ধি না ঘটাই, তাহলে কি আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব? নবী (সা.) বললেন, হ্যাঁ- পারবে। লোকটি বলল, আল্লাহর শপথ! আমি কোনো কিছু বৃদ্ধি করব না। ’ (মুসলিম-১৫)। রোজার মাধ্যমে জান্নাতে সম্মান বৃদ্ধি ঘটে। নবী সা: বলেছেন, ‘জান্নাতে এমন ঘর রয়েছে, যার বাইরে থেকে ভেতর এবং ভেতর থেকে বাইরের দৃশ্য দেখা যায়। একজন গ্রাম্য সাহাবি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এই ঘর কার জন্য? নবী সা: উত্তর দিলেন, যে ব্যক্তি উত্তম ও ভালো কথা বলে, মানুষকে খাবার দান করে, নিয়মিত রোজা পালন করে এবং মানুষ যখন রাত্রে ঘুমিয়ে থাকে তখন নামাজ আদায় করে (তার জন্য এই ঘর)। ’ (তিরমিজি-১৯৮৪)।
হজের সওয়াব লাভের মাস: রমজান মাসে উমরা পালন করা অন্য মাসে হজ পালন করার সমান সওয়াব। নবী করিম (সা.) হজ সম্পন্ন করে ফিরে এসে উম্মে সিনান নামক আনসারি মহিলা সাহাবিকে বলেছিলেন, ‘তুমি আমাদের সাথে হজ করলে না কেন? মহিলা সাহাবি বললেন, আমাদের দু’টি উট। আমার স্বামী একটি উটে হজে গমন করেছেন। আরেকটি আমাদের জমিনে পানি দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। (এ জন্য আমি আপনার সাথে হজে যেতে পারিনি) নবী (সা.) বললেন, ‘তুমি রমজান মাসে উমরা হজ আদায় করে নিও। রমজান মাসে উমরা আদায় করা মূল হজ আদায়ের মতো অথবা আমার সাথে হজ আদায় করার মতো। ’ (বুখারি-১৮৬৩)।
ইফতার করানোর মাস: রমজান মাসে অন্যকে ইফতার করানোর বিরাট ফজিলত রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সেও রোজাদারের মতো সওয়াব পাবে। এক্ষেত্রে রোজাদারের সওয়াব একটুও হ্রাস করা হবে না। ’ (তিরমিজি-৮০৭)।
সুপারিশ লাভের মাস: রোজা ও কুরআন রোজাদারের জন্য কিয়ামতের ময়দানের সুপারিশ করবে। জান্নাতে নিয়ে যাবে। নবী সা. বলেছেন, ‘রোজা ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে খাবার ও শারীরিক চাহিদা থেকে দিনের বেলায় বিরত রেখেছিলাম। তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে রাতে ঘুমানো থেকে বিরত রেখেছিলাম। তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। সুতরাং রোজা ও কুরআনের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। ’ (মুসনাদে আহমাদ-৬৫৮৯)।
শহীদের সমমর্যাদা লাভের মাস: আমর ইবনে মুররা আল জুহানি রা. থেকে বর্ণিত- ‘কজায়া গোত্রের এক ব্যক্তি নবীকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! যদি আমি ‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসুল’ বলে সাক্ষ্য দেই, পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায় করি, জাকাত আদায় করি, রমজান মাসে রোজা পালন করি, তাহলে আমাকে আপনি কোন দলের অন্তর্ভুক্ত মনে করবেন? নবী (সা.) উত্তর দিলেন, ‘তোমাকে আমি সিদ্দিকিন ও শহীদদের ভেতরে গণ্য করি’। (ইবনে খুজাইমা-৩/৩৪০)
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়