নীলফামারী: মধ্যরাত। দূর-দূরান্ত থেকে মাইকে ভেসে আসছে- রোজাদারো উঠো.....সেহরিকা ওয়াক্ত হো চুকা হে.....জাল্দ উঠো আওর সেহরি কারলো...(রোজাদাররা উঠে পড়ুন, সাহরির সময় হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি উঠুন এবং সাহরি করে নিন)।
পুরো রমজান মাসজুড়ে তৎপরতা তাদের। নীলফামারীর সৈয়দপুরের ঐতিহ্য এ কাফেলা তথা ঘুম থেকে জাগানিয়া দলের তৎপরতা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
সৈয়দপুরে সাহরির ঘণ্টাখানেক আগে থেকে বিভিন্ন পাড়া মহল্লার অলিগলিতে রোজাদারদের জাগাতে এভাবে ঘুরে বেড়ায় কাফেলা। এ বছরও ব্যতিক্রম নয়। প্রতিদিন শহরের বাঁশবাড়ি হানিফ মোড় থেকে আজমেরি কাফেলা, মেডিক্যাল মোড় থেকে আশরাফি কাফেলা, মিস্ত্রিপাড়া থেকে বুলান্দ কাফেলা আর আমিন মোড় থেকে হুসাইনি কাফেলাসহ বিভিন্ন কাফেলা বিভিন্ন এলাকা থেকে বের হয়ে রোজাদারদের জাগানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
সৈয়দপুরে আগে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় একাধিক কাফেলার দল থাকলেও কালের বিবর্তনে সংখ্যাটা এখন অনেক কম। তবে ডিজিটাল এ যুগেও এ উপজেলায় এমন কাফেলা দলের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। শহরের গোলাহাটে সাহরির একটু আগে ঘুম ভাঙান আজমেরি কাফেলা দলের সদস্যরা। রিকশায় মাইক লাগিয়ে চলে গজল গাওয়া আর ইসলামিক কবিতা পাঠ। গজল গাওয়ার মাঝে মধ্যে জানিয়ে দেওয়া হয় সাহরির শেষ সময়।
আজমেরি কাফেলার প্রধান ইসলাম জানান, অনেক বছর ধরে এ কাজ করে আসছেন তিনি। তাদের ডাক শুনে মহল্লার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুম থেকে উঠে তাদের একনজর দেখতে বাইরে ভিড়ও করে। রমজান মাসের প্রথম দিন থেকে ঈদের চাঁদ দেখা পর্যন্ত সাহরির জন্য প্রতিদিন রাত ২টার দিকে তারা নেমে পড়েন রোজাদারদের ডেকে তুলতে। রাত জেগে এভাবে ডেকে তোলা তাদের কাছে পরম পূণ্যের কাজ। অনেকে আবার একে সামাজিক দায়িত্ব বলেও মনে করেন।
শহরের গোলাহাট মহল্লার গৃহিনী হামিদা বেগম বলেন, সেই ছোটবেলা থেকে কাফেলা দেখে আসছি। এক সময়ে ঘড়ির প্রচলন ছিল না। সে কারণে রোজদারদের সাহরি করতে অসুবিধা হতো। সেই সময় থেকে এ কাজ শুরু হয়। মূলত কিশোরদেরই এ কাজ করতে দেখা গেলেও এখন বয়স্করাও এ কাজ করছেন।
শহরের বাঁশবাড়ি মহল্লার সকিনা বেগম বলেন, ছোট বেলায় বাবা-মা বয়স কম বলে রোজা রাখতে দিতেন না। কিন্তু এ কাফেলার হাঁক ডাক শুনে ঠিকই ঘুম ভেঙে খাবার টেবিলে যোগ দিতাম। যদিও গত বেশ কয়েক বছর কাফেলার হাঁক ডাক খুব কমে গেছে।
হানিফ মোড়ের বাসিন্দা নয়ন আলী জানান, রমজান মাস এলেই প্রতিরাতে কাফেলার গজলে ঘুম ভাঙে। ঘণ্টা খানেক আগে থেকেই তারা ঘুরে ঘুরে সাহরি খাওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু এখন সব কিছু কেমন যেন পানসে হয়ে গেছে।
মেডিক্যাল মোড়ে আশরাফী কাফেলা দলের সদস্য মো. সিরাজ, আরজু ও জীবন। ঘুম থেকে উঠে মানুষকে জাগানোর কাজে নেমে পড়েন। তারা এতে যথেষ্ট আনন্দ পান। তারা সবাই শ্রমজীবি। ওই কাফেলা দলের বয়োজ্যেষ্ঠ মো. সামির বলেন, আমি ৩৫ বছর ধরে কাফেলার দলে যুক্ত। প্রতিবছরই রোজাদারদের ডেকে তুলি। এলাকার কিছু তরুণ ও যুবক স্বেচ্ছায় রাত জাগার দলে যোগ দেন। তাদের বিশ্বাস এ কাজে মানুষের দোয়া মেলে।
সংস্কৃতি এ কাফেলার বিষয়ে কথা হয় সৈয়দপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মোখছেদুল মোমিনের সঙ্গে। তিনি জানান, এটা সৈয়দপুরের সংস্কৃতি। আগে প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে প্রতিযোগিতা স্বরুপ কাফেলা বের হতো। জুমাতুল বিদার দিন এক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীদের পুরস্কৃত করা হতো। যদিও এখন এ সংস্কৃতিটা অনেকটা কমে গেছে। আমরা স্থানীয় সংস্কৃতি রক্ষার্থে তাদের উৎসাহ দিয়ে আসছি।
কাফেলার সদস্যদের কোনো নির্দিষ্ট চাহিদা নেই। খুশি হয়ে যে যা পারেন টাকা দেন। কেউ কেউ প্রতিদিন খুশি হয়ে অল্প কিছু টাকা দিয়ে থাকেন কাফেলার সদস্যদের। আবার অনেকে একবারে ঈদের আগে কিছু টাকা দেন। এতে রমজান মাসে একেকটি কাফেলার আয় হয় ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো।
সেই দিনগুলো এখন শুধুই অতীত। সৈয়দপুরে এখন আর আগের মত ঘুম ভাঙানো কাফেলা দলের গজল শোনা যায় না। ডিজিটাল প্রযুক্তির এ যুগে এখন মোবাইল ফোনের অ্যালার্মে তাদের ঘুম ভাঙে। কিন্তু সৈয়দপুরের বাসিন্দারা আজও কাফেলা তথা ঘুম জাগানিয়া দলের সুরেলা ডাকে জেগে ওঠেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০২২
এসআই