কলকাতা: শহর কলকাতায় মসজিদের সংখ্যা কম নয়। তার মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ আছে যেগুলো সবাই এক নামে চেনে।
অঞ্চলটা হিন্দু অধ্যুষিত হলেও মসজিদের যে কোনো কাজে এগিয়ে আসেন স্থানীয়রাই। একইভাবে পূজাতেও পাওয়া যায় স্থানীয় মুসলমানদের। ঈদের সেমাই আর দশমীর মিষ্টির বিনিময় প্রথা দেখলে মনে হবে গ্রাম বাংলার কোনো প্রাচীন রূপ।
এক সময় কলকাতার ওই অঞ্চল কেওড়া গাছের ঘন জঙ্গল ছিল। তার মাঝেই ছিল পুকুর। সেখানেই তৈরি হয়েছিল মসজিদ। এ অঞ্চলে এক সময়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের বাস ছিল। দূর দূরান্ত থেকে কাঠুরেরা আসত গাছ কাটতে। কাজের ফাঁকে ওই মসজিদেই হতো উপসনা। যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা নিয়মে বাধা হয়ে দাঁড়ালো সময়। কালের চাকার এক অন্ধকার সময় বাংলা ভাগের দিনগুলো। গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে মুসলিম সম্প্রদায় চলে যেতে থাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। একইভাবে শেকড়ের মূল ছিন্ন করে হিন্দু সম্প্রদায় বাস শুরু করে এ অঞ্চলে। মাঝে শুধু থেকে যায় পুকুর, জঙ্গল আর থেকে যায় মসজিদ। শুধু পালটে যায় উপসনার লোকগুলো।
কালের বিবর্তনে ধ্বংস হয়ে গেল জঙ্গল, মজে গেল পুকুর। আশপাশের জমি হয়ে গেল বেদখল। কার জমি? কে রাখবে এ খবর? সেদিনের শরণার্থীরা পরিণত হতে লাগল নাগরিকে। হয়ে উঠল হিন্দু সম্প্রদায়ের অঞ্চল। এদিকে ভগ্নদশায় পরিণত হতে থাকে মসজিদ। যারা থেকে গেলেন সেবঙ্গে, তারাই নামাজের মাধ্যমে ধরে রাখলেন মসজিদের অস্তিত্ব। অস্তিত্ব নষ্ট হচ্ছে দেখে মুসলিমরা তৈরি করলেন মসজিদ কমিটি। সহযোগিতা করলেন সকলে। বন্ধ হল জমির বেদখল।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এ মসজিদ মুখ বুঁজে সহ্য করেছে অনেক কিছু। এক সময় মসজিদ কমিটির একাংশ, এক জমি মাফিয়াকে প্রায় বেচে দিয়েছিল মসজিদ সমেত জমিটা। অঞ্চলে প্রচার হলো, নতুন করে হবে সবকিছু। এখানে হবে বড় মসজিদ। পাশেই হবে পাঁচতলা বিল্ডিং। হবে মাদরাসা। থাকবে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা, আরও কতকিছু। সেই থেকে এলাকার নাম হতে থাকে বড় মসজিদ। কিন্তু মসজিদ কমিটির কথা প্রকাশ হতে বেশিদিন লাগেনি। এলাকাবাসী থামিয়ে দেয় সেই কাজ।
ততদিনে বড় ফাটল ধরেছে মসজিদের গম্বুজে। ভেঙে পড়ছে পুরনো দেয়াল। মসজিদ পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসেন সবাই। এখনও কাজ সম্পূর্ণ না হলেও ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরছে মসজিদের। এখনও চলছে মসজিদের জমি উদ্ধারের কাজ। স্থানীয়দের সহযোগিতা এগিয়ে এসেছেন লোকাল কাউন্সিলার, সাংসদ, পুলিশ সবাই। এখানে বর্তমান নামাজের মুসল্লিদের ধারণক্ষমতা মাত্র ২০০ জন। তবে মসজিদের যে জমি আছে তাতে দেয়াল উঠে গেলে প্রায় ১০ হাজার লোক একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন। বর্তমানে ইফতার করেন মাত্র ৪৫ জন। আর এর অর্থ যোগান দেন বহিরাগত বিত্তশালী মুসলিমদের পাশাপাশি অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা।
অপর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কলকাতার মসজিদগুলোর সিংহভাগ ইমাম হলেন অবাঙালি। তারা মূলত আসেন উত্তরপ্রদেশ এবং বিহার রাজ্য থেকে। তবে কলকাতায় কয়েকটা মসজিদ আছে যেখানে বাঙালি ইমাম দ্বারাই পরিচালিত হয়। সেই রকমই এই ১৮৭ বছরের পুরনো টালিগঞ্জের বড় মসজিদ। এখানে বাঙালি ইমামের নাম শেখ হাফেজ আবদুল হালিম গফর।
তিনি জানান, এ মসজিদের কোনো আয় নেই। এ মসজিদ চলে দানের ওপর। বিত্তশালী মুসলিমদের পাশাপাশি ভালোবেসে হিন্দুরাও এখানে ইফতারি দেন বা শুক্রবার কিছু দেন। ইমামের কথায়, এ অঞ্চলের মানুষের মহব্বতের কারণেই এ মসজিদ। এখানে ধর্মের ভেদাভেদ হয় না। এখানে সবাই আসেন।
ইমামের সঙ্গে কথা চলাকালীন দেখলাম, বিহারী দাস এবং রাজশ্রী এসেছেন ইফতারের সরঞ্জাম নিয়ে। একজনের হাতে পাঁচ কেজি চিড়া রাজশ্রীর হাতে দইয়ের হাঁড়ি।
তারা বলেন, সারাদিন ওনারা রোজা থাকেন। ভাবলাম দই-চিড়া দিই, শরীর ঠাণ্ডা থাকবে। আমার বাড়ি তো পাশে। আজান শুনেই ঘুম ভাঙে। শুক্রবার উনি (ইমাম) যখন বক্তব্য রাখেন সবই শুনতে পাই। ওনার কোনো কথাই তো খারাপ লাগে না। তাই আমরাও আসি মাঝেমাঝে ইমাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। আপনি বাংলাদেশে লেখালেখি করেন? ভালো কিছু লিখবেন। উনি (ইমাম) খুব ভালো মানুষ। বাংলায় সুন্দর কথা বলেন।
বোঝা যায়, সংস্কৃত বা আরবি যে ভাষায় ধর্ম চলুক, বাংলা ভাষাই সেতুর কাজ করছে এ অঞ্চলের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে। ভাষাই টিকিয়ে রেখেছে সম্প্রীতি। যদি কলকাতার অন্যান্য মসজিদের মতো এখানেও উর্দু ভাষায় চলত শুক্রবারের বক্তব্য। তখনও কি ভালো লাগত রাজশ্রীদের?
বৃহত্তর কলকাতা দেড় কোটির মানুষের বাস। তবে কলকাতা বলতে যা বোঝায় তার জনসংখ্যা ৪৫ লাখ। আর সেই কলকাতা আজও সম্প্রীতি বজায় রয়েছে। এ শহর এখনও সম্প্রদায়িক অস্থিরতা থেকে মুক্ত। এ শহর সবার। এ শহর যেমন খাদ্যে ভেদাভেদ করে না, তেমনি প্রয়োজনে শাসকের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে পিছপা হয় না। এ শহরের প্রতিটা মানুষ স্বাধীনচেতা মনোভাব রাখে। এখানে ঈদ এবং পূজা ভাগ করা যায় না। উৎসব যে সম্প্রদায়ের হোক এগিয়ে আসেন সবাই।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২২
ভিএস/আরএ