ঢাকা: বছরের শুরু থেকেই চব্বিশ সালটা প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করেই অতিবাহিত হলো। জানুয়ারি থেকেই কনকনে শীত, এরপর অতি তীব্র তাপপ্রবাহ, তার মাঝেই আবার বন্যার থাবা।
ফেব্রুয়ারি মাঝামাঝিতে কাটে শৈত্য প্রবাহ
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা শৈত্য প্রবাহ ছিল। ১৬ জানুয়ারিতে তা কাটলেও তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির ওপরে ওঠেনি। পরেরদিন থেকে নামে টানা বৃষ্টি। দুদিনের বৃষ্টিতে ফের শৈত্যপ্রবাহ। থার্মোমিটারের পারদ এরপর কেবল নামতেই থাকে। ২৮ জানুয়ারি এসে তাপমাত্রা নামে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তেঁতুলিয়ায়। ওইদিন ঢাকার তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রির ঘরে নেমে আসে। সাত বিভাগেই বইতে শুরু করে শৈত্য প্রবাহ। এরপর একদিনের বিরতি দিয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শৈত্য প্রবাহ চলে। পরবর্তীতে সীমিত পরিসরে ফের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে আরেকটি শৈত্য প্রবাহের পর কাটে শীতের দাপট। মোট সাতটির মতো শৈত্যপ্রবাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জনজীবন। শুধু রংপুরে জানুয়ারিতে মারা যায় ১৬ শিশু। এছাড়া হার্ট অ্যাটাকেও অনেকের মৃত্যু হয়।
মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক ডজন তাপপ্রবাহ
শীতের প্রকোপ কমতে না কমতেই আসে গরমের দাপট। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত
১৫টির মতো তাপপ্রবাহ দেখা দেয়। এ সময় পাঁচটি হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়। বন্ধ করতে হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ এছাড়া হাসপাতালগুলোতে বাড়তি সতর্কতা নিতে নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
পাঁচ দশকের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড
এপ্রিলে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় যশোরে, যা গত পাঁচ দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় রাজশাহীতে ১৯৭২ সালের ১৮ মে, ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
টানা ৩৭ দিন তাপপ্রবাহ, ৭৬ বছরের রেকর্ড
এপ্রিল ছিল ইতিহাসের অন্যতম উষ্ণতম মাস। এই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৮১ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে বৃষ্টিহীন গ্রীষ্ম তেতে ওঠে। এ মাসে দেশে গড় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ থাকার কথা ১৩৪ মিলিমিটার। সেখানে বৃষ্টিপাত হয় ২৬ মিলিমিটার, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৮১ শতাংশ কম।
আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানিয়েছেন, ৩১ মার্চ থেকে টানা ৩৮দিন ধরে দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহ ৭৬ বছরের মধ্যে রেকর্ড। এ সময় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির আশেপাশে বিরাজমান থাকে। আবহাওয়া অফিসে ১৯৪৮ সাল থেকে যে তথ্য আছে, তাতে এবারই সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে তাপপ্রবাহ বয়ে যায়।
তীব্র তাপপ্রবাহে সাতক্ষীরা, জামালপুর ও পাবনায় একজন করে তিনজন; যশোর ও চট্টগ্রামে দুই শিক্ষক, রাজধানীতে দুজন এবং, চুয়াডাঙ্গায় দুজন মারা যান এপ্রিলে। আর মে মাসেও সিরাজগঞ্জ, সিলেট ও ঢাকায় একজন করে তিনজন মারা যান।
তাপপ্রবাহে কারণে সৃষ্টি হওয়া খরায় বোরো ধান ও আম চাষে ফলন কমে যায়। বিশেষ করে এবার আমের ফলন অর্ধেকে নেমে আসায় দামও বেড়ে প্রায় দ্বিগুন হয়ে যায়।
বানের ভয়াল থাবা
মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় প্রতিমাসের স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়। ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমাল ও রিমাল পরবর্তী সময়ে দেশে তিন হাজার ৩৩৫ মিলিমিটার বর্ষণ হযেছে, যা চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ। এ সময় চট্টগ্রামে ২৩৫ মিলিমিটার, ঢাকায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৫১ মিলিমিটার, যা মৌসুমের সর্বোচ্চ বর্ষণ। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, বরিশালসহ কয়েকটি স্থানে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয় একদিনে। খরার মাঝে এভাবে হঠাৎ হঠাৎ ভারী বৃষ্টিতে দেখা দেয় আকষ্মিক বন্যা।
মে থেকে অক্টোবরে হাফ ডজন বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রতি মাসেই অন্তত একবার করে বন্যা দেখা দিয়েছে। তবে সবগুলোই আকষ্মিক বন্যা। কুমিল্লা, ফেনীর বন্যা শত বছরের ভয়াবহতা ছাড়ায়। সব মিলিয়ে ছয় মাসে কোনো না কোনো সময় ৩০টির মতো জেলার ৭০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। নষ্ট হয় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ও ফসল।
আগস্টে ভারত থেকে নেমে আসার পানি ঢল ও দেশের বৃষ্টিপাত বাড়ায় বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। ২০ অগাস্ট থেকে ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ জনে, এর মধ্যে ২৮ জনই মারা যান ফেনীতে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা জানান, মৃতদের মধ্যে পুরুষ ৪৫ জন। এছাড়া ১৯ শিশু এবং ৭ জন নারী মারা যান।
এছাড়া অক্টোবরে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিন জেলার বন্যায় ১০ জন মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্যে শেরপুর জেলায় ৮ জন ও ময়মনসিংহে ২ জন মারা যান।
ঘূর্ণিঝড়
এবার বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া চারটি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়ে দেশের আবহাওয়ায়। এর মধ্যে একটি আঘাত হানে দক্ষিণাঞ্চলে।
নভেম্বরে ফিনজাল, অক্টোবরে দানা ও সেপ্টেম্বরে আসনা ভারতের উপকূলে আঘাত হানে। ঝড়-বৃষ্টি ছাড়া দেশে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।
তবে মে মাসে রিমাল খুলনা অঞ্চল দিয়ে উঠে আসে। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয় বেশ। রিমালের আঘাতে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোরে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয় ৩৫ হাজার ৪৮৩ ঘরবাড়ি। আংশিক বিধ্বস্ত হয় ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি। এই ঝড়ে ৪৬ লাখ মানুষ নানাভাবে দুর্গত হয়ে পড়ে। মারা যান ১৬ জন।
বজ্রপাত
ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট মাসে বজ্রপাতে ২৯৭ জনের প্রাণহানি হয়। আহত হন ৭৩ জন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম (এসএসটিএফ) দেশের জাতীয় এবং আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশনের স্ক্রল থেকে বজ্রপাতে হতাহতের এ তথ্য সংগ্রহ করে।
এসএসটিএফ জানায়, মৃতদের মধ্যে ১১ শিশু ও ৫৫ জন নারী। ৫৫ নারীর মধ্যে ছয়জন কিশোরী। এছাড়া নিহতদের মধ্যে ২৪২ জন পুরুষ, এদের বেশিভাগই কৃষক। মাঠে কাজ করার সময় যেমন কৃষক মারা গেছেন, তেমনি ঘরে থেকেও রেহাই পায়নি ২৭ জন। রাস্তায় ১৫ জন, বাড়ির উঠানে খেলার সময় ১৪ জন শিশু-কিশোর, আম কুড়ানোর সময় ১১ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন।
সংগঠনটির তথ্য বলছে, এপ্রিলে ৩১ জন, মে মাসে ৯৬ জন, জুনে ৭৭ জন ও সেপ্টেম্বরে ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ১৩ জন করে মারা গেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও জয়পুরহাটে। ফেনীতে ১২ জন, কক্সবাজার ও গাইবান্ধায় ১০ জন করে মারা গেছেন। বাকিরা অন্যান্য জেলায় নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৪
ইইউডি/এসআইএস