ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পর্যটন

ভক্ষক নন, এখন তিনি বন রক্ষক!

মানসুরা চামেলী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০১৬
ভক্ষক নন, এখন তিনি বন রক্ষক! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে: মেরিন ড্রাইভে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাওয়ার পথে পড়ে উখিয়া উপজেলার শফির বিল গ্রাম। রাস্তার একপাশে উত্তাল সমুদ্র, অন্যপাশে পাহাড়বেষ্টিত বনাঞ্চল।

এই গ্রামে থাকেন এক সময়ের বন ধ্বংসকারী নুরুল ইসলাম। কিন্তু সেই তিনি এখন পরিচিত বন রক্ষক হিসেবেই। বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজার গাছের দেখভালকারী হিসেবে পরিবার নিয়ে পাহাড়েই বসবাস নুরুলের।

শফির বিল গ্রামে বন বিভাগের সাড়ে তিন একর পাহাড়ি জমির ওপর গড়ে উঠেছে নুরুলের বন। গ্রামের প্রবেশপথেই চোখে পড়ে তার বনে উঁচু পাহাড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালাকৃতির চাপালিশ গাছ। চাপালিশ ছাড়াও এই বনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় সিভিট, গুটগুইট্টা, বাইট্ট গর্জন, গোদা, তেলী চাকুয়া কড়ই, তেলশুর, হামারসহ ২৭ প্রজাতির দেশীয় গাছ।

এক সময় এই পাহাড়ের বন থেকেই চুরি করে গাছ কেটে জীবিকা নির্বাহ করতেন নুরুল। এজন্য বন বিভাগের কর্মকর্তাদের হাতে পাকড়াও হয়েছেন, হজম করেছেন মারধরও। কিন্তু দারুণভাবে শুধরে গেছেন নুরুল। এখন বন বিভাগের কর্মকর্তারাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

তার এ শুধরে যাওয়ার গল্পটা এমন- গাছ চুরি করে জীবিকা চালালেও ধর্মের প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল নুরুল। একবার মসজিদের ইমামের খুতবায় বনাঞ্চল রক্ষার বয়ানের ব্যবস্থা করা হয়। সেই বয়ান শোনেন নুরুলও। তারপর থেকেই শুধরে যান তিনি। কেবল শোধরানইনি; শপথ নেন, বন রক্ষার কাজের নিজেকে নিয়োজিত করার।

বদলে যাওয়া সেই নুরুল ইসলামের সঙ্গেই কথা বলে বাংলানিউজ। তিনি বলেন, “মসজিদের ইমাম বলেছেন, গাছ কাটা গুনাহ। আগে চুরি করে গাছ কাটতাম। জীবনে অনেক গাছ কেটেছি, গুনাহ করেছি। আর করবো না। সারাজীবন গাছের সেবায় নিজেকে উৎর্সগ করবো। ”

বন রক্ষক দলের সদস্য হিসেবে আরণ্যক ফাউন্ডেশনের অনুদান ও তাদের সঞ্চয় নিয়ে গঠিত থেকে তহবিল ঋণ নিয়ে শফির বিল গ্রামে একটি চা-বিস্কুটের দোকান দেন নুরুল। দোকানের পাশাপাশি গড়ে তোলেন বনাঞ্চল। বেসরকারি সংস্থা আরণ্যক ফাউন্ডেশনের সহায়তায় বেসরকারি নার্সারি থেকে বিলুপ্তপ্রায় গাছের চারা সংগ্রহ করেন। সেই চারা লাগিয়ে এখন জীবন কাটছে তার। যেন গাছই হয়ে উঠেছে তার জীবন।

বনে গাছ লাগানোর পাশাপাশি বাঁশ বাগানও করেছেন নুরুল। যা বিক্রি করে মোটা অংকের আয় হয় তার। এখন স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে স্বচ্ছল জীবন-যাপন চলছে নুরুলের।

নিজ হাতে গড়ে তুললেও সেই বন থেকে গাছ কাটার অধিকার নেই নুরুলের। বরং গাছগুলো কাটার উপযোগী হলে বন বিভাগ তা বিক্রি করে প্রাপ্ত লভ্যাংশের ২৫ শতাংশ দেবে নুরুলকে।

তবে এই লাভ-ক্ষতির হিসাব করেন না নুরুল। তিনি  বলেন, “গাছ লাগালে দেশের লাভ, জাতির লাভ। গাছ জীবন বাঁচায়, অক্সিজেন দেয়। লাভের কথা ভাবছি না, জীবনে অনেক ক্ষতি করছি। এখন আল্লাহ ভালো রেখেছে। বাচ্চাগুলো স্কুলে যায়। সারাজীবন গাছ লাগায় যাবো। ”

নুরুলের বিষয়ে বন বিভাগের কক্সবাজার জেলার রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. ইব্রাহিম বাংলানিউজ বলেন, “একসময় নুরুল গাছের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। সেসময় চুরি করে গাছ কাটতেন। এখনও গাছের ওপর নির্ভরশীল, তবে এখন গাছ রক্ষা করে নির্ভরশীল। তার আগ্রহ দেখে বন বিভাগের পক্ষ থেকে পাহাড়ের সাড়ে তিন একর জমি নুরুলকে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বিশাল বনাঞ্চল তৈরি করেছেন নুরুল। ”

এ বন কর্মকর্তা বলেন, “তার মতো সবাই গাছ কাটা থেকে বিরত হয়ে বন রক্ষার কাজে নিয়োজিত হলে বনাঞ্চল ধ্বংস হতো না। তবে এজন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে। ”

আরণ্যক ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম অফিসার আব্দুল মান্নান বলেন, “যারা একসময় বন উজাড় করার কাজ করতো, আমরা তাদের বিকল্প উপার্জনের ব্যবস্থা করায় এখন নিজেরা বন সংরক্ষণ করছে, পাশাপাশি জীবন যাপনও করছে স্বচ্ছলভাবে। ”

বাংলাদেশ সময়: ১৪১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১৬
এমসি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।