ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পর্যটন

দুবলার চরের ‘ওসি’

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৬
দুবলার চরের  ‘ওসি’ শরনখোলা রেঞ্জের দুবলার চর ইউনিটের ফরেস্টার মো. শাজাহান মোল্লা-ছবি: ডিএইচ বাদল ও মানজারুল

দেশের প্রতিটি থানায় একজন করে অফিসার ইন চার্জ (ওসি) রয়েছে। তবে থানা না হলেও বঙ্গোপসাগরের বুকে গড়ে ওঠা দুবলার চরে ‘ওসি’ (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) রয়েছেন।

দুবলার চর (সুন্দরবন) থেকে: দেশের প্রতিটি থানায় একজন করে অফিসার ইন চার্জ (ওসি) রয়েছে। তবে থানা না হলেও বঙ্গোপসাগরের বুকে গড়ে ওঠা দুবলার চরে ‘ওসি’ (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) রয়েছেন।



থানার না হলেও স্থানীয় জেলেদের আশা-ভরসা তিনিই। শরনখোলা রেঞ্জের দুবলার চর ইউনিটের দায়িত্বে রয়েছেন ফরেস্টার মো. শাজাহান মোল্লা। এ ফরেস্টারই জেলেদের কাছে ওসি  হিসেবে পরিচিত।

কোনো জেলেকে জলদস্যুরা আটক করেছে বা কোনো পর্যটক বিপদে পড়েছেন? ডাকলেই পাওয়া যায় ফরেস্টারদের। আবার সরকারের রাজস্ব আদায়েও ভূমিকা রাখছেন তারা।

শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) শরনখোলা রেঞ্জের দুবলার চর বা আলোর কোল ইউনিটে গিয়ে দেখা মেলে ওসি শাজাহান ও তার সহকর্মীদের। সাগর পারে জেলে ফারুখ শেখ এসেই বললেন ওসি সায়েব সকাল সকালে চলি আয়েছেন। জবাবে শাজাহান বলেন, আমার সকাল হয় ফজরের আগে।

জেলেদের সাগরে মাছ শিকারের অনুমতিপত্র ও তালিকা চেক করতেই সকালে সাগরতীরে হাজির ফরেস্টার, ফরেস্ট গার্ড (এফজি) ও বোট ম্যান (বিএম)। কয়েকটি নৌকা চেকও করলেন।
এক জেলেকে দড়ির স্ট্রেচারে করে বোটে তোলা হলো-ছবি: ডিএইচ বাদল ও মানজারুল
শুধুমাত্র অনুমতিপত্র চেক করেন না। শুঁটকি পল্লী থেকে কেজি প্রতি রাজস্ব আদায় করেন। এতে সরকারের কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয় দুবলার চরের শুঁটকি পল্লী থেকে।

ফরেস্টার শাজাহান মোল্লা (৪৮) থাকেন সাইক্লোন সেন্টারে। নিজেদের কষ্টের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে শাজাহান এবং তার সহকর্মীরা বলছিলেন-আমরা দুর্গম এলাকায় থাকি, এখানে নেই কোনো ডাক্তার, হাসপাতাল। যেকোনো রোগের চিকিৎসা নিতে যেতে হয় মংলা। তবে সেই পথ সহজেই পার হওয়ার নয়। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা লেগে যায় মংলা পৌঁছাতে। গুরুতর অসুস্থ হলে অনেকের পথেই মৃত্যু হয়।

দুবলার চরের জেলে, ফরেস্টার বা অন্য পেশার লোক যারা থাকেন তাদের প্রত্যেককেই এই সমস্যার মুখোমুখী হতে হয়। তাদের ৫ মাসের জীবনযাত্রা সংগ্রামী।

প্রতি বছর নভেম্বর মাস থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫ মাসের ডিউটিতে আসেন বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জেলেদের নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি বন রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এসব কর্মকর্তা।

আলোর কোলে রয়েছে একজন ফরেস্টার, তিনজন ফরেস্ট গার্ড, বোট ম্যান ৭ জন, প্লান্টেশন ম্যান একজন।

ফরেস্ট গার্ড আল-আমিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে বন পাহারা দেই। প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার রাজস্ব আয় করে দেই এই আলোর কোল থেকে। অথচ আমাদের কোনো ঝুঁকি ভাতা বা সার্কেল ভাতা নেই। যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। এরপর যদি বড় কোনো অসুখ হয় তাহলেতো কথাই নেই। !
শরনখোলা রেঞ্জের দুবলার চর ইউনিটের ফরেস্টার মো. শাজাহান মোল্লা-ছবি: ডিএইচ বাদল ও মানজারুল
রাজস্ব আয়ের একমাত্র উৎস জেলে পল্লী। প্রতি কেজি মাছের জন্য ৫টা ৭৫ পয়সা ট্যাক্স কেটে নেওয়া হয়। এছাড়া জেলে ও অন্যান্য দোকানের জন্য এই ৫ মাসের জন্য ৭, ৮ হাজার থেকে শুরু করে ২০, ৩০ হাজার টাকায় লিজ দেওয়া হয়।

ফরেস্টাররা কার্গো ভর্তি শুঁটকি পাঠানোর পর চালান করে পাঠিয়ে দেয় বন্দরে। প্রতি মাসে কয়েক হাজার কেজি শুঁটকি মাছ বিক্রি হচ্ছে আলোর কোল বা দুবলার চরে।

দুর্গম এই এলাকায় কারও অসুখ হলে মংলা, কয়রা, খুলনা যাওয়া ছাড়া চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। আলোরকোল থেকে জোয়ারের সময় মংলা যেতে ৬-৭ ঘণ্টা আর ভাটার সময় হলে লাগে আরও বেশি। আবার কয়রা যেতে ১০-১২ ঘণ্টা লেগে যায় বলে জানান ফরেস্ট গার্ড আল-আমিন।

আরেক ফরেস্ট গার্ড মো. মাসুদ মোল্লা (৫০) জানান, কয়েকদিন আগে এখানে মালো সম্প্রদায়ের সভাপতি পঙ্কজ বাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে এখান থেকে তাকে মংলা নিয়ে যাওয়া হয়, মংলা পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় ৬ ঘণ্টা লেগে যায়। মংলা নিয়ে ডাক্তার দেখানোর পর এখন মোটামুটি অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে রয়েছেন।

তিনি জানান, এরও আগে চাকলা মার্কেটে রামপাল বেল্টের একজন লোক- নাম বলতে পারছি না, তিনি হঠাৎ স্ট্রোক করেন, তাকে মংলা ডাক্তারের কাছে নিতে নিতে মারা যান। এরকম অনেক ঘটনা ঘটে এই আলোর কোল দ্বীপে। তাই আমাদের এখানে ৫ মাসের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দরকার। পাশাপাশি একটি ভাসমান হাসপাতাল করলে এই চরের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

** কটকার সুখ-দুঃখ
**‘মংলায় ভালো হোটেল দরকার’
** রাতের দুবলার চর
** সরু হয়ে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা
** হাড়বাড়িয়ায় লাল শাপলার মিষ্টি পুকুর
** মধুমতিতে আয়েশি ভ্রমণ

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৬
এসএম/এটি/জিপিসহযোগিতায়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।