ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পর্যটন

অফ-সিজনে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৮
অফ-সিজনে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ অফ-সিজনে সেন্টমার্টিনের জনশূন্য সৈকত। ছবি: আজিম রানা

অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল সেন্টমার্টিন ঘুরে আসার। ঈদ বা এ জাতীয় বড় কোনো ছুটিতে পর্যটনকেন্দ্রগুলো এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। এসময় পর্যটকদের গাদাগাদি ভিড়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করার সুযোগ পাওয়া যায়না বললেই চলে। তবে জুলাই-আগস্ট সেন্টমার্টিন যাওয়ার সিজন না। তাই এবারের ঈদুল আযহার (২০১৮) ছুটিতে সেন্টমার্টিন যাওয়ার সিদ্ধান্তটা সাহস করে নিয়েই নিলাম। 

ঈদের তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় বন্ধু জনি আরাদকে নিয়ে রওনা দিলাম সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে। আগে থেকে বাসের টিকিট কাটা না থাকলেও, মনে সাহস ও শরীরে বল নিয়ে সায়দাবাদ পৌঁছলাম সন্ধ্যায়।

সরাসরি টেকনাফের গাড়ি না পেলেও লোকাল বাসে ভেঙে ভেঙে যাব, এমনটাই পরিকল্পনা।  

সায়দাবাদের অনেকগুলো কাউন্টার খুঁজেও যখন কোনো টিকিট মিলল না,  এমন সময় একটা কণ্ঠ ভেসে এলো কানে, ‘চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম’। লোকাল বাসটি দেখে কোনো দ্বিধা না করেই দু’টো টিকেট কেটে উঠে বসলাম। বাস ছাড়ল রাত প্রায় ৮টার দিকে।  

ঈদের ছুটি থাকায় রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই। চট্টগ্রাম পৌঁছলাম রাত প্রায় ১টায়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল তখন। বৃষ্টি একটু থামলে নতুন ব্রিজ গিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম কক্সবাজারগামী বাসের জন্য। বাস পেতে পেতে রাত তখন আড়াইটা।  

বাস কক্সবাজার লিংক রোড পৌঁছল ভোর ৫টার দিকে। সেখান থেকে টেকনাফের উদ্দেশ্যে উঠলাম ‘সরাসরি বাস সার্ভিস’ নামে একটা বাসে।  

টেকনাফ যাওয়ার পথের দু’পাশে চোখে পড়ল অসংখ্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প। বছর খানেক আগেই পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার থেকে এ মানুষগুলো অমানবিক অত্যাচারের মুখে পালিয়ে আশ্রয় নেয় এ দেশে। কবে তারা নিজ দেশে ফিরতে পারবে কে জানে! তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতেই বুকের মধ্যে চলে এলো দীর্ঘশ্বাস।

টেকনাফ যাওয়ার পথের দু’পাশে চোখে পড়ে এমনই অসংখ্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প।  ছবি: আজিম রানা

টেকনাফ পৌঁছলাম সকাল সাড়ে ৮টা নাগাত। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পেটটাকে সাময়িক সময়ের জন্য শান্ত করে ছুটলাম ট্রলার ঘাটের দিকে। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টায় দু’টি ট্রলার ছাড়ে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে। আবহাওয়া খারাপ থাকায় সবাইকে লাইফ জ্যাকেট পরতে বললো কোস্টগার্ড।  

ট্রলার ছাড়তেই শুরু হলো অন্যরকম এক অ্যাডভেঞ্চার। একপাশে বাংলাদেশ অন্যপাশে মিয়ানমার, মাঝখান দিয়ে নাফ নদী। এরই মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলতে লাগলো ট্রলার। যতোই এগিয়ে চলছি দিগন্তে ততোই আবছা হতে লাগলো স্থলভাগ। আর সেইস্থানে যায়গা করে নিতে থাকলো সমুদ্রের দিগন্ত জোড়া নীল জল।  সেইসঙ্গে পালাক্রমে বৃষ্টি আর রোদ অ্যাডভেঞ্চারের মাত্রাটা বাড়িয়ে দিল শত গুণ যা থেকে সিজনাল পর্যটকরা বঞ্চিত।

এভাবে প্রায় ২ ঘণ্টা চলার পর দিগন্তে সরু শলাকার মতো সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভূখণ্ড দেখা দিল। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের কারণে মাঝে মাঝে দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তা। এদিকে ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রচণ্ড দুলছিল ট্রলার।  

এভাবে মোট ৩ ঘণ্টা চলার পর সেন্টমার্টিন জেটিতে গিয়ে পৌঁছলাম। জেটিতে নামার সময়ও প্রচণ্ড দুলতে লাগলো ট্রলার। অতিরিক্ত দুলুনিতে তাল সামলাতে না পেরে একজন পড়েই গেলেন ট্রলার থেকে। কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে তাকে তোলা হলো পানি থেকে। ভাগ্যিস ট্রলার তখন মাঝ সাগরে অবস্থান করছিল না! তাই প্রাণে বেঁচে গেলেন লোকটি।

যাই হোক, আগের দিন সন্ধ্যায় যে পরিমাণ সাহস ও শক্তি নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম সেন্টমার্টিন পৌঁছতে পৌঁছতে তা প্রায় উধাও। এজন্যেই বলি, কেন এই সময়টাকে সেন্টমার্টিন ভ্রমণের জন্য অফ-সিজন ধরা হয়! বৃষ্টি আর ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে যেন আসতে হয়েছে। তাই দ্বীপে নেমেই কোনো মতে লাঞ্চ সেরে হোটেলে চেক-ইন করেই দিলাম ঘুম।  

বিকেলে ঘুম ভাঙতেই বের হলাম সৈকত দেখতে। অফ-সিজনে সেন্টমার্টিন আসার মজাটাই এখানে। পর্যটক না থাকায় পুরো সৈকতই প্রায় জনশূন্য। ফলে একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ মিলল স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে। জেটির কাছেই স্থানীয়দের সঙ্গে আড্ডায় আড্ডায় কাটিয়ে দিলাম সন্ধ্যাটা। স্থানীয়দের প্রসঙ্গে বলতে গেলে প্রথমেই যে কথাটা মাথায় আসে, এরা বেশ সহজ-সরল ও অতিথিপরায়ণ। অতঃপর চাঁদের আলোয় সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে আড্ডা-গান সেদিনের মতো ভ্রমণের ইতি টেনে চলে গেলাম হোটেলে ঘুমাতে।

অফ-সিজনে সেন্টমার্টিনের জনশূন্য সৈকত।  ছবি: আজিম রানা

পরের দিনের ডেসটিনেশন ছেড়া দ্বীপ। সকালে ঘুম থেকে উঠে জিপিএসের সাহায্য নিয়ে রওনা দেই ছেড়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে। হাটা শুরু করলাম গ্রামের ভেতর দিয়ে। আমার ধারণা ছিল না একটা সামুদ্রিক দ্বীপে এতোটা সবুজের সমারোহ দেখতে পাবো। চারপাশে ধানক্ষেত আর কেয়াবন। মাঝের এক জায়গায় দুইপাশের সৈকত চলে এলো খুব কাছে। বিচ ধরে হাটা শুরু করলাম।  

হঠাৎ প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আর এগুতে পারলাম না। কেয়াবনের পাতার নিচে আশ্রয় নিলাম আমরা। সেখানেই পরিচয় হয় নুর আলম নামে এক স্থানীয়র সঙ্গে। পেশায় মৎস্যজীবী। অনেক কথা হল তাদের জীবনসংগ্রাম নিয়ে। দ্বীপের বাকি স্থানীয়দের মতো নুর আলমও যথেষ্ট অতিথিপরায়ণ। তার গাছের পেঁপে না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়ল না আমাদের। বৃষ্টি একটু থেমে এলে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার এগুতে লাগলাম।  

নাহ। কিছুদূর যেতেই আবার বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যেই কিছুক্ষণ সমুদ্রের উত্তাল লোনা জল পাথরে আছড়ে পরার দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম। বিচের পাশে এক বাড়ির গাছে থাকা ডাব দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না। তার অনুমতি নিয়ে নিজেরাই ডাব কেটে খাওয়া শুরু করলাম। বৃষ্টিতে পুরো ভিজে যাওয়ায় সেদিনের মতো ভ্রমণের পরিকল্পনা বাদ দিতে হলো। বিকেলে ছেড়া দ্বীপ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে হোটেলে ফিরে গেলাম।

অফ-সিজনে সেন্টমার্টিনের জনশূন্য সৈকত।  ছবি: আজিম রানা

লাঞ্চ করে আবার ছেড়া দ্বীপের দিকে পা বাড়ালাম বিচ ধরে। পথে এক জায়গায় ডাব পেরে রেখে দিয়েছে ঢাকা পাঠানোর জন্য। সেখান থেকে বড় সাইজের দুইটা ডাব কিনে ফেললাম। ডাবগুলো এতোই বড় ছিল যে খেতে খেতে দম বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম।  

আবার হাঁটা শুরু করলাম রোদের মধ্য দিয়ে। ছেড়া দ্বীপের প্রায় কাছাকাছি আসার পরে টেকনাফ থেকে আসা আরও দুই পর্যটক আমাদের সাথে যোগ দিলো। তাদের দলে ভিড়িয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম।  

গাছ দিয়ে ঘেরা ৩টি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নিয়ে ছেড়া দ্বীপ। মজার ব্যাপার হলো এখানে বসবাস করে মাত্র একটি পরিবার। জিপিএসে স্থলভাগটা দেখতে ত্রিভুজের মতো। শরতের মেঘমুক্ত আকাশ আর সাথে দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি। অনেক দূরে মিয়ানমারের ভূখণ্ড দেখা যায়। সব মিলিয়ে ছবির মতো সবকিছু।

ছেড়া দ্বীপের একমাত্র বসতি।  ছবি: আজিম রানা

তবে বেশি সময় উপভোগ করা গেল না। জোয়ার চলে আসছে, আবার সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছে। ফিরতে হবে খুব দ্রুত। ফিরতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম যেসব জায়গা দিয়ে আমরা বালুর উপর দিয়ে হেটে এসেছি সেগুলোতে এখন হাঁটু পানি। পানি বেড়ে গেলে বিপদে পরে যাব। তাই খুব দ্রুত হাঁটতে হলো।

যখন সেন্টমার্টিনের মুল ভূ-খণ্ডেতে উঠলাম তখন গোধূলি, গরু-মহিষের পাল বাড়ি ফিরছিল রাখালের সাথে। ধুলো উড়িয়ে রাখাল বালক হয়ে আমরাও পালের সাথে সাথে হেঁটে পৌঁছে গেলাম জেটিতে। আরেকপ্রস্থ আড্ডা-গল্প-গান-খাওয়া-দাওয়া করে সেদিনের মতো চলে গেলাম হোটেলরুমে।  

ছেড়া দ্বীপে বাংলাদেশের শেষ প্রান্ত।  ছবি: আজিম রানা

রাতে প্রচণ্ড আবার প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। সকালেও প্রচণ্ড বাতাস। তিন নম্বর সিগন্যাল চলছে। জোয়ারের পানি চলে এসেছে প্রায় জেটির পার্শ্ববর্তী বাজার পর্যন্ত। হোটেল থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পরলাম ট্রলারের উদ্দেশ্যে। ট্রলার ছাড়তে এখনও কিছু সময় বাকি। সাথে থাকা হ্যমোক ঝুলিয়ে বিশ্রাম নিলাম কিছুক্ষণ। এরপর চলে এলাম জেটিতে।  

খারাপ আবহাওয়ার কারণে ট্রলার ছাড়বে কিনা তা নিয়ে দেখা দিল কনফিউশন। ট্রলার মালিক ছাড়তে চাচ্ছেন না। কিন্তু পর্যটকদের কথা চিন্তা করে কোস্টগার্ড ট্রলার ছাড়ার কথা বলছে। এ নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা চলল। শেষে সিদ্ধান্ত হল ট্রলার ছাড়ার। পর্যটকদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ট্রলার ছাড়বে। টিকেট কেটে উঠে পরলাম ট্রলারে।  

ট্রলার ছাড়ার কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো প্রচণ্ড বৃষ্টি আর বাতাস। ট্রলার প্রায় পাঁচ থেকে দশ ফুট উঠা-নামা করছিল। সি-সিকনেসের কারণে বমি করা শুরু করলো কয়েকজন। বিশাল বড় বড় ঢেউ এসে একটু পর পর পুরো ট্রলারের সবাইকে ভিজিয়ে দিতে লাগলো। এভাবে চলল প্রায় দুই ঘণ্টা।  

আস্তে আস্তে থামতে শুরু করলো ঝড়-বৃষ্টি। একটু শান্ত হলো আবহাওয়া। টেকনাফ কাছে আসতে শুরু করলে ট্রলারের সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ঘাটে পৌঁছানোর আগে ট্রলারে উঠে পুরো ট্রলার চেক করলো কোস্টগার্ড। তারা নেমে যাওয়ার পরে ঘাটে ভিড়ল ট্রলার। ধড়ে নামলাম সবাই। একগাদা রোমাঞ্চকর স্মৃতির মধ্য দিয়ে ভ্রমণের ইতি টানলাম আমারা।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৮
এনএইচটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।