ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পর্যটন

অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে ঝুঁকিতে সেন্টমার্টিন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৮
অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে ঝুঁকিতে সেন্টমার্টিন

কক্সবাজার: এক অসাধারণ সৌন্দর্যের নাম সেন্টমার্টিন। নামটি শুনলেই চোখে ভাসে ওঠে স্বচ্ছ নীল জলরাশি, কেয়াবন, পাথুরে সৈকত, প্রবাল, শৈবালসহ বিস্ময়কর সব জীব-বৈচিত্র্যের সমাবেশ।

কিন্তু হতাশার বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে পরিবেশগত ঝুঁকিতে রয়েছে দ্বীপটি সেন্টমার্টিনকে নিয়ে পরিবেশবাদীদের মুখে এখন ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন। পরিবেশবাদীরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ব্যবস্থাই দ্বীপটির জন্য দুঃসংবাদ বয়ে আনবে।

 

সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হওয়া স্বত্বেও পর্যটকদের অবাধ যাতায়াত, দ্বীপের ভারসাম্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা না রেখে একের পর এক স্থাপনা নির্মাণ, দ্বীপের রক্ষাকবচ হিসেবে পরিচিত কেয়াবন উজাড়, পাথর উত্তোলন করে নির্মাণ কাজে ব্যবহারসহ পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কর্মকাণ্ডের কারণে গত একযুগে দ্বীপের ভাঙন প্রকট আকার ধারণ করেছে।

সেন্টমার্টিনের জেটি ঘাঁট।                                          ছবি: বাংলানিউজ

এমন বিপর্যস্ত অবস্থার কারণে ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সেন্টমার্টিন,কক্সবাজার ও টেকনাফ সৈকত এলাকাসহ দেশের ৬টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।

সেন্টমার্টিনে সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ, মাটির পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, বন্যপ্রাণী শিকার, শামুক, ঝিনুক, প্রবাল, শৈবাল, পাথর আহরণ ও সরবরাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও মানা হচ্ছেনা কোনটিই। ইতোমধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপে আইন লঙ্ঘন করে তৈরি হয়েছে শতাধিক হোটেল-মোটেল।

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাব বাংলানিউজকে বলেন, সেন্টমার্টিন কেবল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর একটি দ্বীপ নয়, এটি দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। তাই দ্বীপটি রক্ষায় সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। দ্বীপের ভার বহনের ক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সবোর্চ্চ কতটি হোটেল-মোটেল, কটেজ বা পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে, কোথায় কোথায় স্থাপনা নির্মাণ করলে দ্বীপটির ইকোলজির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, প্রতিদিন কি পরিমাণ পর্যটক দ্বীপে আসতে পারবে, কিভাবে পর্যটন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, দ্বীপটির জীববৈচিত্র্য কিভাবে রক্ষা করা যাবে, এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা কেমন হতে হবে তা এ নীতিমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে।

তিনি বলেন, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ব্যবস্থার কারণে বর্তমানে দ্বীপে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। কেয়াবন ধ্বংস ও পাথর উত্তোলনের কারণে দ্বীপে ভাঙন বেড়েছে। এমনকি এই প্রথমবারের মতো দ্বীপের উত্তর অংশে ৫০টি নলকূপ ও কুয়ার পানিতে লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। দ্বীপে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে গেছে। যা দ্বীপটির জন্য অশনি সংকেত।

অবিলম্বে সুস্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করে দ্বীপ রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্বেগ না নিলে এবং পর্যটকদের আনাগোনা নিয়ন্ত্রণে না আনা হলে সেন্টমার্টিন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে মন্তব্য করেন সাইফুল।  

প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন।  ছবি: বাংলানিউজ

জেলার বিশিষ্ট পরিবেশবিদ বিশ্বজিত সেন বাঞ্চু বলেন, প্রতিটি দ্বীপের ভার বহনের নিদিষ্ট ধারণক্ষমতা থাকে। বর্তমানে এ দ্বীপের জনসংখ্যাই হয়ে গেছে প্রায় ৮ হাজার। এছাড়া পর্যটন মৌসুমে এই দ্বীপে প্রতিদিন আগমন ঘটে প্রায় ১০-১৫ হাজার পর্যটক। যা ভার বহনের ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি।

তিনি বলেন, প্রভাবশালীরা দ্বীপের পরিবেশ ধ্বংস করে অবৈধভাবে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করছে। ইতোমধ্যে দ্বীপে শতাধিক পাকা স্থাপনা নির্মাণ হয়ে হয়ে গেছে। কিছু কিছু হোটেল-মোটেলে পর্যটকেরা যাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সমুদ্র দেখতে পারে, এ জন্য দ্বীপের রক্ষা কবচ খ্যাত কেয়াবন কেটে ফেলা হচ্ছে।  

প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন।  ছবি: বাংলানিউজ

জীববৈচিত্র্য
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের ও মৎস্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই দ্বীপে রয়েছে ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৭ থেকে ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২৪০ প্রজাতির মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী ও ১২০ প্রজাতির পাখি। দ্বীপটির স্বচ্ছ পানিতে নামলে পাথরের স্তূপের ওপর নানা প্রজাতির প্রবাল, শৈবাল, শামুক-ঝিনুক ও অসংখ্য প্রজাতির মাছ দেখা যায়। সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি প্রসিদ্ধ। ভাটার সময় দ্বীপের চারদিকে দেখা যায় বিভিন্ন
প্রজাতির প্রবাল।

ইতিহাস
এই দ্বীপটি মানুষ প্রথম কখন শনাক্ত করে তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে ধারণা করা হয় ১০০ থেকে ১২৫ বছর আগে এই দ্বীপে মানুষের বসবাস শুরু হয়। প্রথমে কিছু আরব বণিক এই দ্বীপটির নামকরণ করে জিঞ্জিরা। তারা চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যাতায়াতের সময় এই দ্বীপটিতে বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করতেন।  

১৮৯০ সালের দিকে কিছু মানুষ এই দ্বীপের বসতি স্থাপনের জন্য আসে। এরা ছিল মূলত মৎস্যজীবী। যতটুকু জানা যায়, প্রথম অধিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করে ১২-১৩টি পরিবার। বসবাসের জন্য এরা দ্বীপের উত্তরাংশ বেছে নেয়।  

আগে থেকেই এই দ্বীপে কেয়া এবং ঝাউগাছ ছিল। জেলেরা প্রচুর পরিমাণ নারিকেল গাছ এই দ্বীপে রোপণ করে। এ কারণে স্থানীয়রা এই দ্বীপের উত্তরাংশকে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে অভিহিত করা শুরু করে। ১৯০০ সালের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরীপ দল এই দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসাবে গ্রহণ করে। তখন খ্রিস্টান সাধু মার্টিনের নামানুসারে সেন্টমার্টিন নাম দেওয়া হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৮
এনএইচটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।