ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পর্যটন

যেখানে নদী-চর ও সমুদ্রের সম্মিলন

অপু দত্ত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২২
যেখানে নদী-চর ও সমুদ্রের সম্মিলন তারুয়া সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের হাত উঁচিয়ে উল্লাস। ছবি: বাংলানিউজ

ভোলার চরফ্যাশন থেকে ফিরে: স্রোতসিনী জলের ঢেউ খেলানো একটি দ্বীপ। আকাশ ছোঁয়া গাছের চারপাশে শ্বাসমূলে ঘেরা।

নৌকা কিংবা ট্রলারের শব্দে কিনারার পানিতে ছোট মাছের দৌড়ঝাঁপ। নদীর বুক পেরিয়ে সাগরের মাঝখানেও সাদা বকের আকাশ মিছিল। ধূসর বালুচরে লাল কাকরার আধিপত্য। অস্ত যাওয়ার সূর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জেলের জাল গোছানোর ব্যস্ততা। সবুজের বুক চিরে সাগর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ভোলার চর কুকরি-মুকরি। তারুয়াসহ আছে আরো নাম না জানা ডুব চর। দুই দণ্ড শান্তির খোঁজে মানুষ দীর্ঘ ক্লান্ত পথ পাড়ি দিয়ে বেড়াতে যান ওই চরে। কয়টা দিন প্রকৃতির কাছে গিয়ে সতেজ হন। সবকিছু মিলিয়ে প্রকৃতি তার সবটুকু রূপ ঢেলে দিয়েছে এই ভূ-স্বর্গে। গত ১৪ ডিসেম্বর আমরা ১৩ জন বন্ধু মিলে ঘুরে এলাম চর কুকরি-মুকরি ও তারুয়া চর থেকে। বিকেলে ঢাকার সদরঘাট থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। সরকারি বন্ধ পেয়ে পর্যটকদের যেন ভীষণ চাপ। ব্যস্ত জীবনে হাঁসফাঁস করা মানুষগুলো ছুটেছে দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে। ভোরে আমরা ভোলার বেতুয়া ঘাটে নেমে মাইক্রোবাসে করে কচ্ছপিয়া ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। খালি পেটে পাক্কা দেড় ঘণ্টা জার্নি করে ঘাটে পৌঁছালাম। ততক্ষণে ঘাটের চারপাশ পর্যটকে ভরা। ঘাটে নাস্তার কাজ সেরে আমরা এবার ট্রলার করে রওয়ানা হই। ভোলা জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চর কুকরি-মুকরি। এখানেই রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। কথিত আছে যে, একসময় এই চরে শুধুমাত্র কুকুর আর ইঁদুর ছাড়া আর তেমন কিছুই ছিল না। এদিকে স্থানীদের কাছে যা মেকুর নামে পরিচিত। তাই এই চরের নামকরণ হয় চর কুকরি-মুকরি। বঙ্গোপাসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনার মোহনায় কুকরি-মুকরির অবস্থান। তো আমরা তেঁতুলিয়া নদী হয়ে পৌঁছে যায় চর কুকরি-মুকরিতে। বিশাল জলরাশির তীরে চরের বুকে সবুজের আধিপত্য যেন নতুনভাবে প্রাণ সঞ্চার করে। সেদিন চর ধরে অনেকটা পথ পেরিয়ে একটি পছন্দের জায়গায় আমরা ক্যাম্পিং করলাম। মোট সাতটা  তাঁবু খাটিয়ে আমরা আশপাশ ঘুরতে বের হলাম। চরের দুই দিকে যতটুকু চোখ যায় অগনতি পর্যটক এবং তাঁবু। স্থানীয় ট্রলার চালক সেলিম চাচার ভাষায়, গত ২৫ বছরে নাকি এত পর্যটক আসেনি। সত্যিইতো দেশে দেশে ঘুরে দেখার মত কয়টিবা পর্যটনকেন্দ্র আছে। মানুষতো সব সময় নতুনের কাছে ছুটে যেতে চায়। সেদিক থেকে ঠাইঁ না পাওয়া শহুরে জীবন ছেড়ে প্রকৃতির কাছে কে না আসতে চায়। এদিকে বিকেল সাড়ে ৪টার পর সেলিম চাচা দুপুরের খাবার খাওয়ান। রাতে বারবিকিউ পার্টি, ফানুস বাতি উত্তোলন আর দেশি হাঁসের মাংস দিয়ে খিচুড়ি খেয়ে তাঁবুতে ঘুম! রাতভর বনের ভেতর থেকে শেয়ালের ডাকসহ বুনো শব্দে রাত কাটল। সকালবেলা ডিম খিচুড়ি খেয়ে তাঁবু গুটিয়ে ট্রলার ধরে রওয়ানা হলাম তারুয়া সমুদ্রসৈকতের দিকে। মধ্য আকাশে থাকা কড়া সূর্য মাথায় নিয়ে ট্রলারে ঘণ্টাকয়েক যাত্রা শেষে আমরা তারুয়ায় পৌঁছালাম। এ যেন এক টুকরো কক্সবাজার! বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে এটির অবস্থান। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার অন্তর্গত সমুদ্র উপকূলে এই চরটি গড়ে ওঠে। সেসময় জেলেরা মাছ ধরতে গেলে এক তারুয়া নামে এক ধরনের মাছ পাওয়া যেতো। স্থানীয়দের ধারণা, সে কারণে এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে তারুয়া। প্রায় সাত কিলোমিটার দীর্ঘ তারুয়া সমুদ্র সৈকতজুড়ে লাল কাকড়ার আধিপত্য। এখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অসাধারণ দৃশ্য অবলোকন করা যায়। এ যাত্রায় পুরো তারুয়া সৈকতে আমরা ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়েছি। সৈকতে একরাত ক্যাম্পিং করার ইচ্ছে থাকলেও সময় স্বল্পতার কারণে আমরা ফিরতে হয়েছে। আমাদের তৃষ্ণা মেটেনি! সেদিন তারুয়া থেকে ফেরার পথে সমুদ্রের মাঝখানে আমাদের ট্রলার বিকল হয়ে যায়। নোঙ্গর করে ঘণ্টাখানেক ভাসার পর আরেকটি ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে আমরা ফিরেছি। এই ঘণ্টাখানেক কোন চরজুড়ে সাদা বকের সমাবেশ, জালে জীবন্ত রূপালি ইলিশ, জেলের জীবন দেখতে দেখতেই কেটে গেছে। ঠিক বিকেল ৫টার লঞ্চে আমরা শহুরে জীবনে ফিরেছি। প্রকৃতির কাছে দুই দিন এক রাতের আনন্দময় মুহূর্ত ব্যস্ত জীবনের যেন মহৌষধ। দিন দিন মানুষ মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর আগ্রহ বেড়েছে। এখনো সমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা চর কুকরি-মুকরি ও চর তারুয়ার রূপে ছেদ পড়েনি। এখনো প্রশাসন হয়তো এখন এলাকায় পর্যটকদের উপস্থিতি নিয়ে খুব বেশি ভাবছে না বলে সুযোগ-সুবিধা নেই বললে চলে। চর কুকরি-মুকরির কথায় যদি বলি। শত শত পর্যটকরা মাত্র দুটি শোচাগার ব্যবহার করতে পারছে। খাওয়ার পানি বলতে একটি টিউবওয়েল। থাকার ব্যবস্থাও অপর্যাপ্ত। তাই কুকরি-মুকরি ও তারুয়াসহ অনান্য এলাকাগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্টদের এখনি ভাবার সময়। সবুজায়িত রূপ ঠিক রেখে যেন পর্যটকরা ঘুরে বেড়াতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। না হয় অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রের মত জৌলিস হারাবে এই জায়গাগুলো।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২২
এডি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।