ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পর্যটন

পোড়ামাটির ফলকে ইতিহাসের আশ্রম!

সোলায়মান হাজারী ডালিম,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০২২
পোড়ামাটির ফলকে ইতিহাসের আশ্রম!

দিনাজপুর থেকে ফিরে: মোগল আমলের শাসন, রাজা-বাদশা, অস্ত্রধারী সৈনিক, রাম-সীতার বিবাহ, তরকা রাক্ষসী বধ, রাসের এক শরে সাতটি তালগাছ ভেদ,লঙ্কাকাণ্ড, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দৃশ্য, কী নেই কান্তজিউ মন্দিরের গায়ের পোড়ামাটির ফলকে। তৎসময়রে সব আখ্যানের আশ্রয় হয়েছে এখানে।

 

কয়েক শত বছরের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এ মন্দির ও চারপাশের জনপদকে ঘিরে রয়েছে আরও কত শত লোক কথা। ঢেপা নদী তীরের কান্তনগর নামে  এ জনপদ নিয়ে রয়েছে অনেক লোকশ্রুতি ও লোকপুরাণ। দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষের কাছে এ প্রাঙ্গণটি পরম পবিত্র ও জাগ্রত তীর্থ ক্ষেত্র। পোড়ামাটির ফলকের চিত্রগুলো থেকে ইতিহাসের পাঠ নিয়ে সমৃদ্ধ হচ্ছেন তারা।  

এবারের দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর পরের দিনে আমরা পা রাখি এ প্রাঙ্গণে। আগে থেকে দিনাজপুরের পাশের একটি জনপদে থাকলেও ভিড়ে এড়ানোর জন্য আমরা বিসর্জনের পরের দিন আসার পরিকল্পনা করি। যদিও যেমনটি ভেবেছি তেমনটা হয়নি। বাস থেকে ঠাকুরগাঁও থেকে কান্ত নগরে নেমেই বোঝা গেল কান্তজিউ এখন দর্শনার্থীতে মুখর।



কান্তনগরে পা রাখার প্রথমেই আমাদের দৃষ্টি কেড়েছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ ও তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবীদের ভাস্কর্য। দারুণ শিল্প-শৈলীতে তৈরি হয়েছে এটি। এর নিচে চার পাশে লেখা আছে বিপ্লবীদের জীবন কথা- এতে চোখ বুলিয়ে রিকশায় চেপে আমাদের গন্তব্য শুরু হয়। যেতে যেতে পথের রুপ আমাদের মুগ্ধ করতে থাকে। মাঠে কাজ করছেন কৃষক-কৃষাণীরা। এখানে যেন নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। একই জমিতে লালশাক তুলছেন তারা। আরো নানা জাতের শীতের ফসলের আগাম চাষ হচ্ছে মাঠে। একটু এগোনোর পর এলো একটি সেতু। রিকশাচালকের কাছ থেকে জানা গেল নিচ দিয়ে বয়ে গেছে পূণর্ভবা নদী। আরও কিছু পথ আগানোর পর চোখে পড়ে কান্তনগর প্রত্নতাত্বিক জাদুঘর। আমরা সেখানে না থেকে চলে যাই মন্দির প্রাঙ্গণে।
 
ততক্ষণে সূর্যের তেজটা কিছুটা কমেছে। ঘড়ির কাঁটায় সোয়া তিনটা। পুরো এলাকাটা সরগরম। মানুষ হাঁটাহাঁটি করছেন। মাঠের এক পাশে অনেকগুলো দোকান সেখানে কেনাকাটা হচ্ছে। মাঠের মাঝ বরাবর কিছু খাবারের দোকান, সেখানেও মানুষের ভিড়। মনে হচ্ছিল কোন মেলা চলছে। স্থানীয় এক দোকানি জানালেন মেলা নয়- সারাবছরই এমন সরগরম থাকে এই প্রাঙ্গণ।

এই লোক সমাগম ঠেলে আমরা পা রাখি মূল মন্দির প্রাঙ্গণে। ভেতরে প্রবেশ করে হঠাৎ বিশাল এক স্থাপনা দেখে সবার মত আমরাও অবাক হই। ক্রমান্বয়ে আমাদের অবাক হওয়ার প্রবণতা আরও বাড়তে থাকে। মন্দিরের দেয়ালগুলো অসাধারণ কারুকাজে সমৃদ্ধ। পোড়ামাটির ফলকে অসাধারণ চিত্রায়ন দেখে মুগ্ধ হতেই হবে। মন্দিরের দায়িত্বে থাকা অমলেন্দু ভৌমিক নামের একজন জানান, মন্দিরের চার দেয়ালে শাস্ত্রীয় চার যুগের কাহিনী চিত্রের মাধ্যমে বর্ণনা করা আছে। এই চার যুগ হলো সত্য, ত্রেতা, দ্বাপরে ও কলি। সত্যযুগে নারায়ণ, ত্রেতায় রাম ধনুকারী, দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণ ও কলিতে গৌরাঙ্গ মহা প্রভু।

মন্দিরের ওপরের অংশে দক্ষিণ দিকে আছে সত্য যুগের ঘটনা।  উত্তর দিকে আছে ত্রেতা যুগের ঘটনা। পূর্ব দেয়ালে দ্বাপর যুগের ঘটনা ও পশ্চিম দেয়ালে আছে কলি যুগের বর্ণনা। পৌরাণিক জীবনাশ্রিত টেরাকোটাগুলোর গভীরে নিহিত তাপর্য অনুধাবন করতে গেলে অজান্তেই সনাতন ধর্মাবলম্বী দর্শকের মনে রামায়ণ, মহাভারত ও অসংখ্য পুরাণের ঘটনার ভিড়ে হারিয়ে যায়। প্রেমিক ও নায়ক বেশি শ্রীকৃষ্ণের লীলা দেখে ভক্ত মনে সম্বিত হারিয়ে যায়। মথুরা বৃন্দাবনের পথে কোন অজানা অপার্থিব স্বপ্নময় জগতে।  
শুধু মন্দিরের জন্য নয়, দিনাজপুর জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং কাহারোল উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরপুর ইউনিয়নের যেখানটায় কান্তজীউ মন্দিরের অবস্থান, সে স্থানটি ঐতিহাসিকভাবেও অনেক প্রাচীন।

চাঁদ সওদাগরের উপাখ্যানের সঙ্গে আলোচিত এ অঞ্চলের স্মৃতি ও লোকশ্রুতির যোগসূত্র রয়েছে বলে লিখেছিলেন ইতিহাসবিদরা।  মন্দিরটি দেখলে মনে হয়, এটি শুধু ইটের পর ইটে গাঁথা ইটের মন্দিরই নয়, বরং যেন মন্দিরের আকারে শিল্পীর আশ্চর্য কল্পনার রঙিন তুলি দিয়ে রচনা করা একটা অলিখিত মহাকাব্য।  

মন্দির প্রাঙ্গণে কথা হয় ব্রিটিশ নাগরিক জন ও পপি জামানের  সাথে। তারা সুদূর যুক্তরাজ্য থেকে এসেছেন এ মন্দিরটি দেখতে।

জন জানান, এই স্থানটি একটি সমৃদ্ধ লোকজ ঐহিহ্যাবহী স্থান। এখানে এসে জানতে পেরেছি শত শত বছরের আগের লোক কথা। তার স্ত্রী পপি জামান জানান, বাংলাদেশ আমাদের শেকড়। সেই শেকড়ের লোকজ ইতিহাস জানতে এসেছে এই মন্দিরে।


 
দিনাজপুর প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকী বলেন, মন্দিরটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রত্নতত্ত্ব ও পর্যটন বিভাগ যৌথভাবে মন্দিরটি সংস্কারের কাজ করেছে। এখানে একটি হোটেল, মোটেল স্থাপন করা হয়েছে। পাশেই রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কান্ত নগর প্রত্নতাত্বিক জাদুঘর। মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে কান্তনগরে আসতে ও ঘুরে যেতে পারে, সেজন্য এখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা জোরদার থাকে।  

স্থানীয় কাহারোল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল লতিফ বলেন, কান্তজিউ মন্দির আমাদের জনপদের সম্পদ। এটি  সারা পৃথিবীর অন্যতম প্রত্নতাত্বিক ঐতিহ্য। এটির প্রতি যত্নশীল হওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব। আমরা পরম যত্নে আগলে রেখেছি আমাদের এই সম্পদকে ।

গোড়ার কথা: 

মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বের শেষ দিকে এক ব্রহ্মচারী দেবোত্তর সম্পত্তি রেখে যান। দিনাজপুর গেজেটিয়ারের মতে উক্ত ব্রহ্মচারীর নাম কাশী নাথ ঠাকুর । ব্রহ্মচারী কাশী ঠাকুরের প্রধান শিষ্য শ্রীমন্ত ঐ দেবোত্তর সম্পত্তির মালিক হন। শ্রীমন্তের পুত্র সন্তান ছিল না। শুধু ছিল একমাত্র কন্যা, তার নাম লীলাবতি। লীলাবতির সাথে রংপুরের বর্দ্ধন কুঠির রাজপুত্র হরিরামের বিয়ে হয়। লীলাবতি ও হরিরামের একমাত্র পুত্র শুকদেব। ঐতিহাসিকদের মতে এই শুকদেব রায় থেকে দিনাজপুর রাজবংশের উদ্ভব।
রাজা শুকদেবের দুই স্ত্রীর মধ্যে প্রথমার গর্ভে জন্মেছিলেন রামদেব এবং জয়দেব এবং দ্বিতীয়ার গর্ভে জন্মেছিলেন প্রাণনাথ ।



রাজবংশের প্রচলিত নিয়মানুসারে পিতার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠপুত্র সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তিনি অল্প কিছুদিন পরেই মারা যান এবং সিংহাসনে আরোহন করেন জয়দেব। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, অল্প দিনের মধ্যে তিনিও মারা যান। তাদের দুই ভাই এর রাজত্বকাল ছিল ১৬৭৭-১৬৮২ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ মাত্র পাঁচ বছর। বড় দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর ১৬৮২ খৃষ্টাব্দে রাজা প্রাণনাথ সিংহাসনে আরোহন করেন এবং ৪০ বছর রাজত্ব করেন। তিনি শুধু দিনাজপুর রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন না, ছিলেন তৎকালীন বাংলার অন্যান্য রাজাদের মধ্যমণি।

প্রাণনাথের অপর দুই ভাইয়ের স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও তার প্রতিপক্ষ মহল ঘটনাটি ভিন্নভাবে প্রচার করে ঘোড়াঘাটের ভারপ্রাপ্ত ফৌজদার রাঘবেন্দ্র রায়। পরে রাঘবেন্দ্র রায় দিল্লীর সম্রাট আওরঙ্গজেবের (ঔরঙ্গজেব) দরবারে মিথ্যা অভিযোগ করেন যে, গুপ্ত ঘাতকের দ্বারা বড় দুই ভাইকে হত্যা করে প্রাণনাথ সিংহাসন আরোহন করেন। তাছাড়া সে দুঃশাসক, প্রজাশোষক, মোগল আনুগত্যের অস্বীকারকারী এবং রাষ্ট্রদ্রোহী। মোগল সম্রাট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সন্তোষজনক কৈফিয়ত প্রদান করার জন্য প্রাণনাথের প্রতি নোটিশ জারি করেন। প্রাণ নাথ নোটিশ পেয়ে দ্রুত দিল্লি যাত্রা শুরু করেন।

নামকরণ: 

হিন্দু ধর্মের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ১০৮ নামের মধ্যে শ্রীকান্ত (রুক্মিনীকান্ত) একটি নাম। তাই মহারাজা প্রাণনাথ শ্রীকৃষ্ণের ‘কান্ত’ নামের অনুসারে মন্দিরটির নাম রাখেন ‘কান্তজিউ মন্দির’ অর্থাৎ “কাত্ত” হচ্ছে কৃষ্ণের নাম, আর “জীউ” হচ্ছে সম্মান প্রদর্শন। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর মন্দিরের নামানুসারে সেই গ্রামটির নাম রাখা হয় কান্তনগর। নাম করণের বিষয়ে আরও আলোচনা রয়েছে।  



নির্মাণ সময়: 

ইতিহাসবিদ মোহরাব দিনাজপুরের ইতিহাস পড়ে জানা যায়, কান্তজিউ মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন রাজা প্রাণনাথ। ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে রাজা প্রাণনাথের মৃত্যু হয়। পরে রাজার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ রায় মন্দিরটির নির্মাণকাজ শেষ করেন। ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ শেষ হয়।  

মন্দিরকে ঘিরে যত আয়োজন:

সারা বছরই কান্তজিউ মন্দির মূখর থাকে। দেশ-বিদেশ থেকে আসে ভক্ত ও দর্শনার্থীরা। সারা বছরই চলে বিভিন্ন পূজা অর্চনা ও অনুষ্ঠান। এর মধ্যে রাসমেলা অন্যতম। প্রতি বছর কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথীতে শুরু হয়ে মাসব্যাপী চলে এই মেলা। জৈষ্ঠ্য মাসের চাঁদের পূর্ণিমা তিথীতে শ্রী কৃষ্ণের স্নানযাত্রা হয় এখানে। প্রতিবছর মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশ তিথীতে শিবরাত্রি ব্রত পালিত হয়। বৈশাখ মাসের চাঁদের পূর্ণিমা তিথীতে বৌদ্ধ পূর্ণিমায় শুরু হয় ৪০ প্রহর ব্যাপী তারকব্রক্ষ্ম নামযজ্ঞ অনুষ্ঠান। ফাল্গুন মাসের চাঁদের পূর্ণিমা তিথীতে দোল পূর্ণিমা অনুষ্ঠিত হয়। জন্মাষ্টমীর দুই একদিন আগে নৌ-বিহারে রাজবাড়ি গমন হয়। রাজবাড়িতে তিন মাস অবস্থান করার পর কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথীর দু্ই একদিন আগে পালকিযোগে আবার আনা হয় কান্তজীউ বিগ্রহ। এটি এখানকার একটি বড় আয়োজন। এছাড়াও প্রতিদিন চলে আরও নানা পূজা অর্চনা।  

নির্দেশনা:

ঢাকা থেকে বাস অথবা ট্রেন যোগে আপনাকে আসতে হবে দিনাজপুর শহরে। সেখান থেকে আবার বাস অথবা সিএনজিচালিত অটোরিশাসায় আসতে হবে কান্তনগর রাস্তার মাথায়। সেখান থেকে রিকশায় বা টমটমে ১০ টাকার ভাড়া। পথ ১ কিলোমিটার। কেউ যদি বিমানে আসতে চান তাহলে নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমান বন্দরে নেমে পূর্ব উল্লেখিত পথে আসতে হবে। থাকার জন্য এখানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একটি গেস্ট হাউজ রয়েছে। মন্দিরের আশ পাশেই রয়েছে খাওয়ার হোটেল। এছাড়াও ইচ্ছে করলেই দিনাজপুরে শহরে গিয়ে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে।

তথ্য সূত্র- 
কান্তজীউ মন্দিরের ইতিহাস- মেহরাব আলী
ইটে গাঁথা মহাকাব্য: কান্তজীউ মন্দির- উপেন রায়
দিনাজপুরের ইতিহাস (১ম-৫ম খণ্ড)- মেহরাব আলী
জেলা পরিক্রমা, দিনাজপুর
বাংলাদেশের ইতিহাস, পরিতোষ কুমার কুণ্ড
বাংলাদেশের ইতিহাস, বেলাল হোসেন সরকার


বাংলাদেশ সময়: ১৪২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০২২
এসএইচডি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।