ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ফ্রান্স থেকে জাহিদুর রহমান

আড়ালের কষ্টগুলো দেখে না কেউ

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৬
আড়ালের কষ্টগুলো দেখে না কেউ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

প্যারিস (ফ্রান্স) থেকে: ভালো বেতনের প্রলোভনে দেশ ছেড়েছিলেন। বাণিজ্য ভিসায় প্রথমে স্পেন।

সেখান থেকে ট্রেনে চেপে এসেছিলেন ফ্রান্সে। অচেনা, অজানা জায়গা। দুর্বোধ্য ভাষা। যাদের ভরসায় সাগর, মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এসেছিলেন স্বপ্নের দেশে। আসতে না আসতেই সে স্বপ্নভঙ্গ!

রেল স্টেশনে দেখা নেই তাদের। অথচ এই শহরে নতুন স্বপ্ন বোনার জন্য তাদের হাতেই অগ্রিম পাঠিয়েছিলেন ৫শ ডলার। তারপর তীব্র কষ্ট আর ক্ষোভ। সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে ফেরার। কিন্তু হাতে ছিলো না একটি সেন্টও!
তারপর বাধ্য হয়েই পথে নামলেন। উভারভিলের ক্যাতসিমা এলাকায় উঠলেন একটি মেসে। এক রুমে আটজন থাকতেন গাদাগাদি করে। সেখান থেকে চলে এলেন ক্লিশি এলাকায়।

টানা দু’বছর কোনো কাজকর্ম নেই। বাড়ি থেকে পাঠানো টাকায় দিন চলতো তার। প্রথমে কাজ নিলেন ক্লিশি এলাকার একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁয় ওয়েটার পদে। কাগজপত্র নেই। বেতন তাই চারশ ইউরো। অন্যদের তখন ১৫শ।

তারপর ওয়েটার থেকে ডিশওয়াশার। সব ধরনের কাজ শেষে নিজের মেধা আর পরিশ্রমে আজ তিনি নিজেই রেস্টুরেন্ট মালিক। তিনি  ব্রাহ্মনবাড়িয়ার পুনিয়াউট গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে কামাল মিয়া (৩৫)।

ছয় ভাই দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় কামাল। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েই চলে আসেন স্বপ্নের শেষ ইউরোপে। প্রথমে স্পেনে ঢুকে সুবিধা করতে না পেরে চার মাসের মাথায় চলে আসেন ফ্রান্সে। দু’বছর বেকার থেকে প্রথমে ভারতীয় রেস্টুরেন্ট হয়ে যোগ দেন সেন্ট্রাল প্যারিসে ইতালীয় একটি রেস্টুরেন্টে। ডিশ ওয়াশার হিসেবে বেতন মাত্র এক হাজার ছয় মাসে কাজ শিখে ফেললেন। ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টের শেফ রেনার্দোর সহযোগিতায় কিচেন শেফ হিসেবে প্রথমে দেড় হাজার, পরে বেতন বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ইউরোতে।

এভাবে সাতটি বছর অবৈধ অভিবাসী হিসেবেই তার দিন কাটে এ দেশে।

২০০৭ সালে  ভ্যানিসা এক্সাভিয়ার (৩৪) সঙ্গে পরিচয়। অন লাইন ভয়েজ চ্যাটে। তারপর বিয়ে। এল দো ফ্রান্স এলাকায় ঘর সাজানোর পণ্য দিয়ে শুরু করলেন ডেকোরেশন শপ। দিলেন বাংলাদেশি গ্রোসারি শপও। তার পরের বছরের মাথায় আরেকটি।

সাফল্যের ধারাবাহিকতায় যুক্ত হন আমদানি বাণিজ্যের সঙ্গে। তৈরি করেন ওয়্যার হাউজ। এখানেই প্রবলভাবে ধাক্কা খান। অব্যাহত লোকসানে বরবাদ হয়ে যায় এক যুগের বেশি সময়ের সঞ্চয়। ছেড়ে দিতে হয় দু‘টি দোকান।

তবে পিছু হটার পাত্র নয় কামাল মিয়া। আবার ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যয়ে ফিরে গেছেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়। ফ্রান্স রেস্টুরেন্ট ১৫ বছরের অর্জন। এরই মাঝে ফ্রান্সে বাড়ি কিনেছেন। সাফল্য বলতে দেশ থেকে এখানে এনেছেন দুই সহদোর আলাল ও বিল্লালকে।

কামাল মিয়া বাংলানিউজকে জানান, প্রবাসে সবাই চাকচিক্যময় জীবনটাই দেখে। আড়ালে থাকা কষ্টগুলো দেখে না কেউ। বৈশ্বিক মন্দা, সন্ত্রাসবাদসহ নানা কারণে দেশগুলোতে আগের মতো অবস্থা নেই। এখন চট করে প্রতিষ্ঠা পাওয়াটাও স্বপ্নের ব্যাপার।

প্রবাসে কষ্ট করেছেন, যেভাবে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন, দেশে এমন চেষ্টা করলে আরও ভালো কিছু করা যেতো বলেই উপলব্ধি তার।

দুই যুগ আগে এসেই দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন চালাতে হয়েছে দেশ থেকে মা বাবার পাঠানো অর্থকড়ি দিয়ে। এখন তো অবস্থা আরও খারাপ।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে এখানে আসার আগে কেবল ভাবতে হবে একটি কথাই। যে পথে পা বাড়াচ্ছি সেখানে জীবনের কতটুকু লাভ ক্ষতি। সেটা হিস‍াবে থাকলেই অনেক প্রচলিত ও অবধারিত বিড়ম্বনা থেকে নিজেকে এড়ানো যায়- দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৬
এএ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।