ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

প্যারিস থেকে জাহিদুর রহমান

বাংলার আলো ছড়াচ্ছেন অনেক ফরাসি

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৬
বাংলার আলো ছড়াচ্ছেন অনেক ফরাসি ছবি: বাংলানিউজটোেয়েন্টিফোর.কম

প্যারিস (ফ্রান্স) থেকে: বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা, চর্চা বা অনুবাদের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে প্যারিস। অনেক ফরাসিই এখন শিখছেন বাংলাভাষা।

কেউ ভাষাকে ভালোবেসে, কেউ বা আবার কর্মসূত্রে বা বাংলা ভাষায় জ্ঞান চর্চার উদ্দেশ্যে শিখছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের রক্তে কেনা বাংলা ভাষা।

বাংলা ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন ভিনদেশি অনেকে। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন তারা। এভাবে অনেকেই বাংলা সাহিত্যেকে পৌঁছে দিয়েছেন ফরাসি পাঠকদের কাছে।

শিল্পকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, নৃ-বিজ্ঞান অার দর্শনের শহর ফ্রান্সের প্যারিসে রয়েছে অ্যাঁস্তিত্যু নাসিওনাল দে লাঁগ জোরিয়াঁতালে। ইংরেজিতে যাকে বলে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড সিভিলাইজেশান বা ইনালকো।

বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, উন্নয়ন, সম্ভাবনা ও বাংলা ভাষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এখন নিয়মিত নানা আয়োজন চলে এখানে।

ইনালকো অডিটোরিয়ামে নানা পার্বন আর দিবস ঘিরে ইনালকো এবং বাংলাদেশ দূতাবাস যৌথভাবে আয়োজন করে নানা অনুষ্ঠান।

এসব আয়োজনকে ঘিরে বাংলাদেশ আর ভিনদেশি ভাষা, শিল্প-সংস্কৃতির ধারক ও বাহকদের মিলনমেলা বসে এখানে। চলে একে অপরের সঙ্গে কৃষ্টি, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির বিনিময়।

ফ্রান্সের ইনালকো ইউনিভার্সিটিতে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন ফিলিপ বেনোয়া।

তিনি জানান, ১০৯টি ভাষার ওপর পড়ানো হয় এখানে। বাংলাদেশে কর্মসূত্রে যাওয়া কূটনীতিবিদ বা ডিফেন্স অ্যাটাসে থেকে শুরু করে অনেক ফরাসি এখানে আসেন বাংলা ভাষা শিখতে, এমনকি দেশটির শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ম্যাদাম স্যুফি অ্যাবের্টও দেশটিতে যাবার আগে এখান থেকে শিখেছেন বাংলা।

ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড সিভিলাইজেশান বা ইনালকোর পাশাপাশি ইউনেস্কোর সদর দফতরও এই প্যারিসে। জাতিসংঘের যে সংস্থাটি একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

দিনটি ছিলো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। ইউনেস্কোর সেই প্যারিস অধিবেশনের পর থেকেই  ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি। যে কারণে বিশ্বের ইতিহাসে  ভাষার জন্যে প্রাণ দেওয়ার নজির সৃষ্টিকারী বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা নিয়ে অনেকেরই রয়েছে আগ্রহ আর কৌতুহল।

ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম সহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান,প্যারিসে ওরিয়েন্টাল ভাষা ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট বিভিন্ন ভাষা-ভাষি মানুষদের একই প্লাটফরমে তুলে এনেছে। সেখানে নিজেদের মধ্যে শিল্প ও সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময় করেন অনেকে।

রাষ্ট্রদূত এম সহিদুল ইসলাম নিজেও ফরাসি ভাষায় পারদর্শী। যে কারণে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তাদের মতো করেই তুলে ধরছেন সেখানকার সরকার ও সাধারণ মানুষের কাছে।

তিনি জানান, এর আগে ব্যাপক উৎসাহ ও আনন্দঘন পরিবেশে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে পালিত হয়েছে বাংলাদেশ দিবস। যেটির উদ্বোধন করেন ইনালকোর প্রেসিডেন্ট মানুএল ফ্রাঙ্কে। সে অনুষ্ঠানে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক, গবেষক ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন  বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ম্যাদাম স্যুফি এ্যাবের্ট।

বাংলা নিয়ে গর্ব করার মতো আরো অনেক কাজই করেছেন ফরাসিরা।

জন্মসূত্রে ফরাসি নাগরিক ফ্রাঁস মঁতেরু। যিনি গবেষণা ও অনুবাদের জগতে  ফ্রাঁস ভট্টাচার্য নামে পরিচিত। জন্ম প্যারিসে ১৯৩৩ সালে। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস এই অধ্যাপক বাংলা পড়িয়েছেন পঁচিশ বছর। প্যারিসের হাউজ অব হিউম্যান সায়েন্সেসের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।

অক্লান্ত গবেষণার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছেন ফ্রাঁস মঁতেরু। ইউনেস্কো প্রকল্পের অধীনে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের ফরাসি অনুবাদ করেছেন তিনি। ফরাসি ভাষায় আরও অনুবাদ করেছেন বিপ্রদাসের ‘মনসামঙ্গল’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ ও ‘আনন্দমঠ’, তারাশঙ্করের ‘রাইকমল’, রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’, ‘চার অধ্যায়’ ও ‘যোগাযোগ’।

বাংলা সাহিত্যের এই গবেষণার স্বীকৃত স্বরূপ ২০১২ সালে রবীন্দ্রভারতী তাকে ডি-লিট উপাধি দেয়। পরে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বর্ণপদক’ দিয়ে এই গুণিকে সম্মান জানায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

প্যারিস প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই বলেছেন,যারা বাংলাকে নিয়ে কাজ করছেন, বাংলা ভাষাকে তুলে ধরেছেন, এখন বাংলাদেশের সময় এসেছে  তাদের কর্মের সন্মাননা জানানোর।

রাষ্ট্রদূত এম সহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ভিনদেশিরা যেভাবে বাংলাকে ধারণ করছেন, তা আমাদের জন্যে অনেক গর্বের। এর মাধ্যমে মানুষে মানুষে সংযোগ বেড়েছে।

তিনি জানান, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড সিভিলাইজেশান বা ইনালকেতে শিক্ষার্থী রয়েছেন প্রায় নয় হাজার। এক হাজার শিক্ষক। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী শেখেন চায়নিজ ভাষা। আগে বাংলা বিভাগে শিক্ষার্থী থাকতেন ৮/১০ জন। এখন সবার সম্মিলিত উদ্যোগে ক্রমেই শিক্ষার্থী বাড়ছে। এখন দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ২০ থেকে ২২ জন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৬
জেডআর/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।