ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

তিন্দু হয়ে বাঘিসং

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৪ ঘণ্টা, জুলাই ৮, ২০১৬
তিন্দু হয়ে বাঘিসং ছবি: লেখক

‘না সমুদ্র না সমতল/ হবে অরণ্য/ নাহ্ তাও না/ তাহলে কোনো পুরাকীর্তি হবে হয়তো/ তাও না/ তবে কি? পাহাড়!’ প্রতিদিনও যদি নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াই তবুও তৃপ্তি মেটে না ভ্রমণ পিপাসার, যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনো পাহাড়ের সান্নিধ্যে না যাই। যতবারই পাহাড়ে যাই ততবারই আপন মনে বলে উঠি ‘কতদিন পরে দেখিলাম তোমায়।

দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় পাহাড় রয়েছে। তবে আমার প্রথম পছন্দ বাংলার স্বর্গ বান্দরবান জেলার পাহাড়গুলো। সেখানে গেলে মনে হয় এই পাহাড়, পাথর, মাটি, ঝিরি, ঝরনা খরস্রোতা সাঙ্গু নদী- এসবই যেন আমার অতি আপন। আর আপন মনে হবেই বা না কেন? বান্দরবানে বাস করা আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর প্রায় সব সম্প্রদায়ের আতিথ্য রয়েছে বেশ। আর বম সম্প্রদায়ের তুলনা তারা নিজেরাই। তাদের ভালোবাসা আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ।

আমার মতো আমাদের প্রিয় সংগঠন দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরাও পাহাড়ের সঙ্গে মেলবন্ধনে নিজেদের জড়িয়েছে বেশ আগেই। সবার ভালোলাগা, সেই ভালোবাসার টানেই হঠাৎ সিন্ধান্তে এক ঝটিকা ট্যুর। ঢাকা থেকে প্রথমে চকরিয়া-চকরিয়া থেকে আলীর গুহা, আলীর গুহা থেকে দেশের দ্বিতীয় উচ্চতম সড়কপথে ডিম পাহাড়ের পাশ দিয়ে থানচি বাজার। থানচি বিজিবি ক্যাম্পে রিপোর্ট  করে ট্রলারে চড়ে তিন্দু।  

ওয়াও! তিন্দু তোর রূপের বর্ণনা আমি কি লিখে পাঠকদের বুঝানোর ক্ষমতা রাখি? চেষ্টা না হয় করি।  

এবার ঝটিকা ভ্রমণের ফিরিস্তি  দেই-দুই ঘণ্টা লেট করে গাড়ি পৌঁছালো সকাল দশটায় চকরিয়াতে। দেরি হওয়ায় পকেটের টাকা অতিরিক্ত যা খসার খসলো আমাদেরই। আলী কদমের লোকাল বাসের বদলে একেবারে থানচি বাজার পর্যন্ত চান্দের গাড়ি রির্জাভ হলো। ভ্রমণ স্বার্থক ও সফল করার জন্য দে-ছুট কখনোই টাকার চিন্তা করে না। এবারও ঠিক তাই। চান্দের গাড়ির ড্রাইভার নুরুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র। একজন দক্ষ গাইড হিসেবেও আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন।

চকরিয়া থেকে ফাঁসিয়াখালি হয়ে দক্ষিণে আলী কদম সড়ক চলে গেছে এঁকেবেঁকে। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় রোমাঞ্চকর যাত্রা। তার উপর শাহেনশাহর মতো জিপে চড়া। সব মিলিয়ে আমাদের ভাবখানাই আলাদা। মনের মধ্যে অন্যরকম থ্রিল অনুভব করছি। শিবাতলী বাজারে গাড়ি ব্রেক, টুকটাক সদাইপাতি। অতঃপর লামা পিছনে ফেলে আর্মি ক্যাম্প পাশ কেটে পৌঁছে যাই আলী কদম উপজেলার পান বাজার।  

চকরিয়া থেকে পানবাজার ৫০ কিলোমিটার। কিন্তু মায়াবি প্রকৃতির বুক চিরে পাহাড়ি পথে মনে হলো গাড়ি স্টাট নিতেই যেন পথের শেষ। চা পানের বিরতি শেষে এবার ছুটছি থানচি অভিমুখী। আলী কদম থেকে থানচির দূরত্ব ৩৩ কিমি। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে উদ্বোধন হওয়া দেশের দ্বিতীয় উচ্চতম সড়কপথ এটি। ডিম পাহাড় লাগোয়া এ সড়কপথে ভ্রমণের আনন্দই আলাদা।  

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সড়কের উচ্চতা ৮১৩ মিটার। থ্যিংকন পাড়া আর্মি ক্যাম্প চেকপোস্ট পার হওয়ার পর আপনার দৃষ্টি হয়ে থাকবে অপলক। গাড়ি যতই এগিয়ে যাবে ততই চোখে ধরা পড়বে প্রকৃতির নানান রূপ। কিছু কিছু বাঁক পড়বে যা সত্যিই আপনাকে রোমাঞ্চিত করবে। নৈসর্গিক প্রকৃতির মায়ায় আছন্ন হয়ে কখন যে থানচি ব্রিজে চলে এলাম টেরই পাইনি।  

থানচি বাজারে খেয়েদেয়ে এবার তিন্দুর পথে। কষ্ট পাই গণশৌচাগার না থাকায়। পর্যটকদের পকেট কাটতে যাদের নেই জুড়ি তাদের মনে একবারও কি দেয় না উঁকি, দূর-দূরান্ত থেকে আসা লোকজনদের জন্য একটা ওয়াশরুমের ব্যবস্থা করি! অন্তত টাকার বিনিময়ে হলেও পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা অতি জরুরি।  

বিজিবি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে ট্রলার ভাসে সাঙ্গুর জলে। তখনও বর্ষা নামেনি। তাই পানি কমে যাওয়ায় নদীর তলদেশ দেখা যায়, স্ফটিক স্বচ্ছ জলে চেহারা দেখে নিজের বিবেককে জিজ্ঞাসা করি তুমি কি হতে পার না নদীর পানির মতো স্বচ্ছ? 

ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই পৌঁছাই তিন্দু। সত্যিই তিন্দুর প্রকৃতি এমনি যতবারই যাবেন না কেন এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রহস্য ভেদ করা কখনোই সম্ভব নয়। সব কথার এক কথা বান্দরবান যদি বাংলার স্বর্গ হয় তাহলে সেই স্বর্গের রাজধানী হলো তিন্দু। ভাবছেন লিখতে গিয়ে বেশি বাড়িয়ে লিখছি, মোটেও না। নিজ চোখে দেখার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে যান মাত্র দু’দিনের জন্য। আহ্‌ হা তখনই বুঝবেন, কি দেখেননি এতদিন এই সোনার দেশে।  

আমাদের ঠাঁই হয় কাঠ দিয়ে তৈরি তিনতলা কটেজে। কটেজ বলতে অন্য সব গতানুগতিক কটেজের মতো নয়। এক্কেবারে সোজা বাংলায় যাকে বলে মাদুর বিছানো বেডিং। তবে মজা অন্য জায়গায়- গ্রিলছাড়া ছোট কাঠের জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই মেঘ ছুঁয়ে যাবে হাতের নরম তালু। ভাবতে থাকুন। আর এই ফাঁকে দে-ছুটের দামালরা আধো জোছনার আলোতে হিমেল হাওয়ার দোলে পাথরে সাঙ্গুর শিতল পানিতে গোসল সেরে নেই মন ভরে।  

নদীতে নামার পর মন চাইছিল না যে উঠি। তবু উঠি, সেই সুযোগে থানচি থেকে আনা মুরগি, নৌকার মাঝি হোসেন রান্না করে রেখেছে রেডি। আদিবাসীদের ঘরে বৈঠা ভাত, আলুভর্তা, ডিম হোসেনের করা মোরগ ভুনা আহ্ খেতে কি স্বাদই না। এবার চলো পাড়াটা ঘুরে দেখি, পাড়ার নাম তিন্দু। মোট ৬৪টি আদিবাসী বিভিন্ন সম্প্রদায় পরিবারের বসবাস। মারমা ও ত্রিপুরা পরিবার বেশি, মাত্র একটি পরিবার খুমি। এবার যাই ঘুমাই। দুই রুম বুকিং থাকলেও এক রুমেই গাদাগাদি। গভীর রাত অব্দি ডনের খাজুরা প্যাঁচাল আরাফাতের নাক দিয়ে বাঁশির সুর, ঘুম কাতুরে ইউশার এলোমেলো ভাব আর কাইউম ভাই ভাবে কাগো লগে আইলামরে বাপ!

এ দেখি ২৪ ঘণ্টাই ওপেন হার্ট। এতো কিছুর পরও সামান্য ঘুমানোর চেষ্টা করি। উঠতে হবে ফজরের সময়। মরিচ পোড়া ঘুম দিয়ে ফজর নামাজ পড়েই উঠি পাহাড় চূড়ায়। অসম্ভব ভালোলাগা সূর্যোদয়ের সুখস্মৃতি নিয়ে এবার ছুটি বড় পাথর।  

বিশ্বাস করুন তিন্দুর বড় পাথর আর বাঘিসং যদি কেউ না দেখেন তাহলে এ ভুবনে জন্মানোটাই যেন তার বিফল। তিন্দুপাড়া থেকে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই নৌ-যোগে যাওয়া যাবে। সেখানে গেলে দেখবেন পাথর আর পাথর- হরেক সাইজের পাথর ওর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পাথরটা ওটাকে রাজা পাথর হিসেবে সবাই চেনে। আদিবাসীরা সেখানে পূজা করে বলি দিয়ে থাকে। নানান আকৃতির পাথরের ফাঁক গলে নৌকা এগিয়ে চলে। কিছুদূর গিয়েই বাঘিসং এ থেমে মেতে উঠি উল্লাসে।

দু’পাশে পাহাড় উঁচু হয়ে যেন দিগন্ত ছুঁয়েছে। পাহাড়ের গায়ে জন্মানো গাছগুলো দেখে মনের মাঝে ভিন্ন রকমের অনুভূতির দোলা দেয়। আর পায়ের নীচে পাথুরে চিক চিক সাদা বালির লুটোপুটি, হাত বাড়ালেই শঙ্খের পানি সব কিছু মিলিয়ে এপাশটায় ভর করেছে প্রকৃতির উজাড় করে দেওয়া সব রূপ।  

যাবেন কীভাবে?
ঢাকা থেকে বিভিন্ন পরিবহনের বাস চলে চকরিয়া। চকরিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে আলী কদম/চান্দের গাড়িতে পানবাজার নেমে আলীর সুড়ঙ্গ ঘুরে আবারো চান্দের গাড়ি/ বাইকে ডিম পাহাড়ের পাদদেশের পথ ধরে থানচি বাজার, থানা ও বিজিবি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে ট্রলারে করে তিন্দু। ভাড়া চকরিয়া থেকে আলীকদম-লোকাল বাসে ৬০/= টাকা, আলীকদম থেকে থানচি বাজার মোটরবাইকে জনপ্রতি ২০০/= টাকা আর চকরিয়া থেকে থানচি পর্যন্ত রিজার্ভ চান্দের গাড়ি ভাড়া পড়বে ৫০০০-৬০০০/= টাকা। থানচি থেকে বাঘিসং ট্রলার ভাড়া দু’দিনের জন্য নেবে ৩০০০ – ৩৫০০/= টাকা। গাইড খরচ দু’দিনের জন্য ১২০০/= টাকা। সাঙ্গু নদীতে এখন পানি কম তাই, এক ট্রলারে পাঁচজন।  

খাবেন কি থাকবেন কোথায়: আদিবাসীদের দোকান-বসত রয়েছে। মাথাপিছু ১৫০ টাকার বিনিময়ে খেতে ও থাকতে পারবেন অর্থাৎ, ১৫০+১৫০= ৩০০ টাকা। স্পোশাল খাবার খেতে চাইলে থানচি থেকে নিয়ে আসতে হবে।

খরচপাতি: দু’দিনের ভ্রমণে মাথাপিছু খরচ হবে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। তবে একটু কষ্ট করে ভ্রমণ করলে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার মধ্যেও সম্ভব।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, জুলাই ০৮, ২০১৬
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।