ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

‘বাংলাদেশে চিকিৎসা নেই’- পাঠক ও বিশেষজ্ঞ প্রতিক্রিয়া

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫১ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০১৭
‘বাংলাদেশে চিকিৎসা নেই’- পাঠক ও বিশেষজ্ঞ প্রতিক্রিয়া  চিকিৎসাপ্রার্থী রোগিদের অধিকাংশই বাংলাদেশের ছবি: ড. মাহফুজ পারভেজ

বেঙ্গালুরু (কর্ণাটক) থেকে: টিপু সুলতানের মহিশুর ও বেঙ্গালুরু ভ্রমণের নানা পর্যায়ে মাথায় ঘুরছিল ‘বাংলাদেশে চিকিৎসা নেই!’ কথাটি। বাংলাদেশের চিকিৎসার্থীদের নানা বক্তব্যের ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশে চিকিৎসা নেই!’ প্রতিবেদনটি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এ প্রকাশিত হলে ব্যাপক পাঠক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান থেকে ফেরদৌস গাজি মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা জানিয়ে ই-মেইল করেন। তিনি বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি নিয়ে নিজের যে অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেন, তা সত্যিই বেদনাদায়ক।

ঢাকার গোলাম মওলা স্বপনের মেইলেও স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিরাজমান বিরূপ ও বিচিত্র তথ্য রয়েছে। মেইল ছাড়াও ফেসবুকে বহুজন প্রতিক্রিয়া জানান। ফলে বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না। বিষয়টিকে ভাবনার বাইরেও রাখা যায় না।

‘বাংলাদেশে চিকিৎসা নেই!’

বাংলাদেশের চিকিৎসা সম্পর্কে বেঙ্গালুরু আসা রোগিদের মতামত, দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া ইত্যাদির সঙ্গে এখানকার বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য জানার আগ্রহ হলো। ফলে ব্যাপক ও অধিক হারে বাংলাদেশের রোগিদের এখানে আগমনকে স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা কিভাবে দেখেন, তা জানতে চেষ্টা করেছি। এর পেছনের অন্তর্নিহিত কারণটি জানা হলে একটি তুলনামূলক চিত্র পাওয়ার আশা করা যায়।

বেঙ্গালুরু শহরের নানা স্থানে হাসপাতাল পেলেই আমি সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করে চমৎকার মতামত পেয়েছি। ছয়টি হাসপাতালের জনা দশেক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, বাল্যকালে শেখা ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কিউর’ বক্তব্যটি চিরন্তন সত্য। এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা রোগ ও রোগির চিকিৎসার পাশাপাশি তাকে সুস্থ থাকার মন্ত্র শেখায়। রোগ হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করার দীক্ষা দেয়। কেবল ওষুধ-পত্র বেচা-বিক্রি করাই তাদের লক্ষ্য নয়, মানুষকে সুস্থ, সুন্দর জীবনের পথ দেখানোও তাদের উদ্দেশ্য।

বেঙ্গালুরু শহরের প্রখ্যাত হাসপাতালগুলোতে এক বা একাধিক বিশেষজ্ঞ কাউন্সিলর থাকেন, যারা রোগির হাল-হকিকত জেনে কিভাবে ও কোথায় চিকিৎসা করাবেন, সে ব্যাপারে গাইড করেন। তাদের অনেকেই চিকিৎসক বা পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ। আমার আলোচনা প্রধানত তাদের সঙ্গেই হয়েছে। কারণ, এরাই আগত রোগিদের খোঁজ-খবর রাখেন। কোন ধরনের বিজ্ঞাপন বা প্রচার যাতে না হয়, সে জন্য আমি এই লেখায় হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞদের নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকেছি। চিকিৎসার জন্য মানুষ বাইরে যাচ্ছেই।

বাংলাদেশ থেকে অধিক হারে রোগি আসার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ জানতে পেরেছি এসব বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে। তবে প্রায় সকলেই একটি বিষয়ে একমত যে, জীবন-যাপন প্রণালীর বিশৃঙ্খলা ও অনিয়মতান্ত্রিকতার কারণে বাংলাদেশে রোগির সংখ্যা বেশি। তারা আসেন ভুল ডায়াগনোসিস নিয়ে। প্রকৃত রোগ শনাক্তকরণে ক্রুটি থাকে। আর থাকে বিভিন্ন রিপোর্টের মধ্যে ভুল। ডাক্তার, নার্স ও কর্মীদের আচরণ নিয়েও তাদের মনোভাব ইতিবাচক নয়। তারা মনে করেন, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও জীবন-যাপন প্রণালী সম্পর্কে সামাজিক দায়িত্বশীলতা ও ব্যক্তিগত সচেতনা বাড়ানো হলে রোগির সংখ্যা কমবে।

একটি কথা কানে বাজছে, ‘তেল ম্যাৎ খা না’। তেল, চর্বি, ঘি ইত্যাদি খাওয়ার ব্যাপারে চরম নিষেধাজ্ঞা জানিয়েছেন তারা। বলেছেন, খাবারের পাশাপাশি শরীরচর্চা করার কথা। ওজন কমানোর তাগিদ দিয়েছেন। বলেছেন, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তামুক্ত ‘হেলদি লাইফ লিড করো’। ‘প্রাণ ভরকে বাঁচো। ’ জীবনকে স্বাস্থ্যকর ও সুস্থ্য-ইতিবাচকভাবে উপভোগ করার প্রণোদনা তাদের কাছে রোগ সারানোর অন্যতম হাতিয়ার।

এসব কথা বলার কারণ, বাংলাদেশ থেকে যেসব রোগি আসেন, তাদের অধিকাংশেরই ওজন বেশি। কায়িক শ্রমের অভ্যাস নেই। জীবন-যাপন বিশৃঙ্খল। অপরিমিতিবোধ আছে। আর আছে, খাদ্য সম্পর্কে চরম ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক অসচেতনতা। তেল, মশলা ছাড়া কম-সেদ্ধ উদ্ভিদজাত খাদ্যই যে গুণে-মানে শ্রেষ্ঠ, এই বোধ বাংলাদেশের সর্বত্র এখনো সৃষ্টি হয় নি। প্রাণিজ খাদ্যের চেয়ে উদ্ভিদ শ্রেণির খাদ্যের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কেও সজাগ নন বহু মানুষ। হামলে যা-তা খাওয়ার অভ্যাস অনেকেই ছাড়তে পারেন নি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের রোগিরা প্রায়ই আসেন চরম ও শেষ অবস্থায়। নিয়মিত চেকআপ করিয়ে স্বাস্থ্যবিধি পালন করে রোগ ঠেকিয়ে রাখার ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ার কাজটি অনেকেই সামর্থ্য থাকার পরেও করেন না। কেবল রোগে শয্যাগত হলেই তাদের বোধদয় হয়। তখন অনেক ক্ষেত্রেই করার কিছু থাকে না। ‘সুস্থতা প্রথমত নিজের হাতে’ এই কথাটির দিকে জোর দিয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘চিকিৎসক সাহায্যকারী মাত্র। কেউ ভালো থাকতে চাইলে চিকিৎসক তাকে সহযোগিতা করেন। ভালো থাকার মূল দায়িত্ব মানুষের নিজস্ব। সচেতনতার সঙ্গে জীবন-যাপন করে এই দায়িত্ব পালন করতে হয়। ’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন শুধু বৃদ্ধ ও বয়স্ক রোগিই আসছেন না। বাংলাদেশ থেকে আসা তরুণ ও যুবক রোগির সংখ্যাই এখন এখানে বেশি। ‘কেন?’ প্রশ্ন করে লম্বা উত্তর পাওয়া গেল: ভবিষ্যত অনিশ্চয়তা, পেশাগত জীবনের চাপ, অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন শরীরের হরমোন-উৎসেচক নিঃসরণকে প্রভাবিত করে। এর সঙ্গে অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুড যেমন চিকেন রোস্ট, তন্দুরি, বার্গার-পিৎজা এবং রেড মিটের তৈরি নানা খাবার হার্ট, কিডনি, হজমের জন্য খুবই ক্ষতিকারক। ডায়াবেটিকের কারণও এসব। কেননা, এ সমস্ত খাদ্যাভাস রক্তের কোলেস্টেরল এবং শর্করার মাত্রাকে দ্রুত পরিবর্তন করে দেয়। কোলেস্টেরলের বৃদ্ধির জেরে ধমনীর ভেতরের অংশ সরু হয়ে যায়। এছাড়া কমবয়সিদের কেরিয়ারে চাপ থাকার জন্য অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারণে হার্টে ব্লকেজ দেখা দেয়। কিন্তু তা বোঝা যায় না। তরুণ-যুবকদেরকেও এজন্য স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার দরকার আছে। খাবার ও জীবন প্রণালীর দিকে মনোযোগী হওয়া কর্তব্য। পথে-ঘাটে পাওয়া যায় পর্যাপ্ত ফল।  ছবি: ড. মাহফুজ পারভেজ

আরেকটি বিষয়ও বেশ মজার। শুধু উচ্চ রক্তচাপ থাকলেই যে, হৃদরোগ বা অন্যান্য রোগ হবে, এমন নয়। নিম্ন রক্তচাপের কারণেও নানা রোগ হতে পারে। এ কথাটি অনেকেই জানেন না। এ ব্যাপারটিও মাথায় রাখতে হবে। তবে সকল বিশেষজ্ঞ এই মত পোষণ করেন যে, জীবনশৈলীর ইতিবাচক পরিবর্তন এবং শরীরচর্চার মাধ্যমে শরীরের নানা কল-কব্জা সচল রাখা ও সুস্থ্য-নিরোগ থাকা সম্ভব। এই বিষয়ে গুরুত্ব দিলে রোগের প্রকোপ ও রোগির সংখ্যা কমবে। পাশাপাশি, যান্ত্রিক ও দ্রুতলয় জীবনের চাপ ও চ্যালেঞ্জ রোধ করতে নিয়মিত ধ্যান ও প্রার্থনা করার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন বিশেষজ্ঞরা।

জীবন-যাপনের ইতিবাচকতা মানুষকে কত সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম রাখতে পারে, তার উজ্জ্বল প্রমাণ দক্ষিণ ভারত। কালচে রঙের পেশিবহুল দ্রারিড় জাতিগোষ্ঠির মানুষগুলো সর্বদাই কর্মচঞ্চল। সুস্বাস্থে ভরপুর মানুষগুলো উজ্জ্বল ও চকচকে। মোটা বা তাজা নন, তারা সুঠাম ও সবল।

খাদ্যের ক্ষেত্রেও দক্ষিণ ভারত বিশেষ অগ্রগামী। ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্য, তেল-মশলা কম, সবজি, দুধ, ফল ইত্যাদি তাদের প্রধান খাদ্য-উপাদান। পথে-ঘাটে সর্বত্র ফল কেনার ও খাওয়ার স্বাস্থ্যসম্মত সুলভ ব্যবস্থা রয়েছে। হোটেল, রেস্তোরাঁতেও নানা পদের স্বাস্থ্যকর খাবার পাওয়া যাচ্ছে। আর আছে কর্মস্পৃহা। নিজের কাজ নিজে করা এবং সময় পেলেই প্রার্থনা করার অভ্যাস তাদের মব্জাগত। পরিচ্ছন্নতা বোধও প্রবল। খাওয়ার হোটেলে তো বটেই থাকার আবাসিক হোটেলেও ঝকঝকে ব্যবস্থা। পানের পিক, সিগারেটের গোড়া বা ছাই এখানে-সেখানে ফেলার প্রশ্নই ওঠে না। বরং চারপাশে বৃক্ষ, পুষ্প ও বিহঙ্গের মেলা জীবনকে করছে আলোকিত ও উচ্ছ্বল।

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা যে শুধু একগাদা ওষুধ ধরিয়ে দেওয়ার নাম নয়, উন্নত ও সুস্থ জীবনের সন্ধান দেওয়াও কর্তব্য, এ বোধ আমাদের দেশের সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কবে জাগ্রত হবে, কে জানে!

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।