এবারের সফরে তাই বাইসনের খোঁজে আগরতলা ঢুকেই সোজা রওয়ানা ১১০ কিলোমিটার দূরের দক্ষিণ জেলায়।
সিপাহীজলা জেলা হয়ে তৃষ্ণা পৌঁছাতে পৌঁছাতে হয়ে গেলো বিকেল।
তবে ভারতে গউর বা গব হিসেবে পরিচিত বাইসন এ বনের প্রধান আকর্ষণ। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বিলোনিয়া-সোনামুড়ার এ জঙ্গল গিয়ে মিশেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে। তাই বিচরণ করতে করতে এরা কোনোসময় চলে যেত বাংলাদেশে। যদিও কাঁটাতারের বেড়া হওয়ায় এখন আর এটা হয় না।
১৬ রুপির টিকিট কেটে লম্বা লম্বা সবুজ ঘাস, কাজু বাদামসহ বিভিন্ন গাছের বাগানের মধ্যে দিয়ে ব্যাটারিচালিত অটোয় আমাদের নেওয়া হলো একটি বড় পুকুরের পাশে। সেখানে থাকা টাওয়ারটি পরিত্যাক্ত। পাড়ে রয়েছে বসার জায়গা। চালক বললেন এখানে অপেক্ষা করুন, দেখতে পেলেও পেতে পারেন।
একটু বাদেই দূরে কালো গরুর পাল দেখেই গায়ে কাঁটা দিলো এক ঝলক। ভ্রম দূর হতেও দেরি হলো না। গরু আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে বোঝা গেলো পথ আছে ওদিকে। তাই এবার বসার প্ল্যান লেকের পাড় ধরে একটু এগিয়ে। ০.৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিশেষভাবে সংরক্ষিত। গড়ে তোলা হয়েছে বাইসন পার্ক। কয়েকটি পুকুর খনন করা সেখানে।
এসব জলাশয়ে পানি খেতে আসে বাইসন। লাগানো হয়েছে ঘাস। তুলে দেওয়া হয়েছে বসতি। বিরল বাইসন রক্ষায় এ উদ্যোগ বেশ কাজে দিয়েছে রাজ্য সরকারের। এখন আর এলাকাবাসীর হাতে প্রাণ হারাতে হয় না বাইসনের। তাই পঞ্চাশে নেমে যাওয়া এ প্রাণীটির সংখ্যা এখন ১৫০ এর উপরে। জানাচ্ছিলেন বাইসন পার্কের টিকিটম্যান।
সকালে ও বিকেলে এরা খাবার খেতে বের হয়। এমনই এক কনে দেখা বিকেলের আলোয় উজ্জ্বল সবুজের কার্পেটের মতো ঘাসে পা চালিয়ে একটু অপেক্ষা করতেই বড় একটি গাছের মধ্যে কি যেন নড়ে উঠলো। খেয়াল করলেন সহকর্মী জনি। ক্যামেরার লেন্স তাক করে কয়েকটি ক্লিক করে জুম করতেই বোঝা গেলো এটাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাইসন, যে প্রাণীটিকে টিভির পর্দায় অত্যন্ত তেজস্বী দেখেছি খেলার মাঠে। আবার শিহরণ! বাইসন!
এদের আক্রমণে মৃত্যুর খবর অনেক শুনেছি। এমনকি বনে ঢোকার আগেও। তাই দুরু দুরু বুকে আস্তে আস্তে এগোনো। যা আছে কপালে, ছবি তোলা চাই। মাঝে-মধ্যে একটু মুখ উঁচিয়ে দেখে কি মনে করে নিচের দিকে নেমে গেলো। সহকর্মী বাদল ভাইয়ের হাতেও ক্যামেরা। তাই দুজনে একসঙ্গে সামনে এগোতে থাকা। একটু এগিয়ে উঁচু থেকে ঢালুতে দেখা গেলো আরেকটিকে। লম্বা ঘাসের আড়ালে কালো শরীর। পাশে ছোট জাতের এক ধরনের বাঁশ।
আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে মুখ তুলে দেখার চেষ্টা করলো। তারপর খেতে খেতে সরে যেতে থাকলো দূরে। মহিষের এ বন্য প্রজাতিটির শক্তি নাকি সাংঘাতিক। আর ঘণ্টায় ছুটতে পারে ৬০ কিলোমিটার বেগে। তাই মুখের দিকে তাকালেই ভয় একটু পেতেই হয়। একটি থেকে দুটি দেখেই মহাখুশি আমরা।
ততক্ষণে পাশের লম্বা ঘাসের আড়ে সাড়া দিলো আরেকজন। আমাদের থেকে হাত বিশেক দূরে। আমরা উপরে, সে নিচে। পিঠে আবার পোকার লোভে বসে একটি শালিক। হাজার কেজি ওজনের বাইসনের পিঠে ২শ গ্রামের পাখি! কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেও ঢুকে পড়লো পাশের ছোট্ট বনে।
এর কিছুক্ষণ পর যা দেখা গেলো তা দেখে তো চোখ ছানাবড়া! সারি ধরে বের হতে থাকলো একে একে ১০টি। দলের সামনেরজন বিশালকায়। বোঝা গেলো সেই দলনেতা। তার পিছে পরিবারে সবচেয়ে ছোট সদস্যটি। মাসখানেক বয়স হবে হয়তো। সারি ধরে তার সরে যেতে লাগলো দূরে।
আমাদের পরে যারা এ স্পটে এসেছে তারাও আমাদের দেখাদেখি চলে এলো। বাইসনের পাশাপাশি মানুষের উপস্থিতিও বাড়তে লাগলো। দলের সঙ্গে যেতে কি মনে করে তাকালো আবার পিছে। ঠিক যেন ক্যামেরার লেন্সে। কি বুঝে আবার শুরু করলো হাঁটা।
দূরের একটি টিলায় দুটো আবার উঠে দাঁড়ালো। এবার দূর থেকেই হংকার ছেড়ে যেন চলে যাওয়ার আভাস দিলো। চোখে-মুখে তার হিংস্র রাগ। তাদের রাজ্যে তাদের বিরক্ত না করে অন্যদেরও বিরক্ত না করার অনুরোধ জানিয়ে ফেরার পালা। সারাদিন টানা জার্নির ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো বন্য অবস্থায় বাইসন দেখার আনন্দে। বিকেলের মিষ্টি আলো, যাকে কনে দেখা আলোও বলা হয়, সেই আলো হয়ে উঠলো আশীর্বাদ। দলের কয়েকজন ও টিকিটম্যান বললেন, সব দিন এদের দেখা যায় না, আপনারা অনেক দূর থেকে এসে একবারেই দেখা পেলেন। সত্যি ভাগ্যবান।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৬ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৭
এএ/