তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালে আপামর মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কাছে সহযোগিতার ডাক দেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের নানা পরিষেবা দিয়ে সহযোগিতা করলেও নিজে থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী সরাসরি পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেনি। যুদ্ধের শেষ দিকে ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের ওপর আক্রমণ করে বসে। তাতে ভারত বাধ্য হয়ে যুদ্ধে নামে। ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত প্রভাতী ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা 'ত্রিপুরা টাইমস'র এক্সিকিউটিভ এডিটর তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক মানস পাল বাংলানিউজকে একথা জানান।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রথম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে প্রথম আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তান সেনা বাহিনীর গোপন পরিকল্পনা ছিলো তারা ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে আক্রমণ শুরু করলে ভারতের নজর পশ্চিমাঞ্চলে চলে যাবে। এই সুযোগে তারা পূর্ব পাকিস্তানের লাগোয়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে রাতের আঁধারে আক্রমণ চালিয়ে রাজধানী আগরতলা দখল করে নেবে। এতে একদিকে তারা আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেদের সেনাবাহিনীর সুনাম প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার অন্যতম একটি ঘাঁটি নিজেদের কব্জায় নিয়ে মুক্তিবাহিনীর ভিতকে দুর্বল করে দিতে পারবে।
তাদের এহেন পরিকল্পনার বড় কারণ ছিল এই যুদ্ধে পূর্বাঞ্চলে কলকাতার পর ত্রিপুরা তথা আগরতলা ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল।
তবে পাকবাহিনীর এই গোপন পরিকল্পনার কথা ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে আগেভাগেই চলে আসে। ভারতীয় গোয়েন্দাবাহিনী জানতে পারে পাক সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা জেলা থেকে আখাউড়া হয়ে আগরতলায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে। তাই কুমিল্লা জেলার গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় অস্থায়ী সেনাশিবির স্থাপন ও বাঙ্কার তৈরি করে জওয়ান মোতায়েন ও অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করে রাখে তারা।
১৯৭১ সালে ৩রা ডিসেম্বর পাকবাহিনী স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে আক্রমণ শুরু করে। ভারতীয় বাহিনী তাদেরকে উপযুক্ত জবাব দেয়। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা এলাকায় পাক সেনাশিবির লক্ষ্য করে ভারতীয় সেনারা পাল্টা আক্রমণ চালায়।
১৪ গার্ড রেজিমেন্টের মেজর ও পি কোহলি'র নেতৃত্বে ভারতীয় সময় রাত ২টায় আলফা ও ব্রাভো এই দুই কোম্পানির সেনা জওয়ান কুমিল্লা সেক্টরের গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) প্রবেশ করে। রেলের দুটি ট্রেক ধরে ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কা ও ল্যান্স নায়েক গোলাব সিং'র নেতৃত্বে দুটি লাইনে ভারতীয় সেনা জওয়ানরা এগিয়ে যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে তাদেরকে নজর রেখে রেল লাইনের নিচের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন মেজর কোহলি।
রাত আড়াইটে নাগাদ ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কার পা পাকবাহিনীর পাতা ফাঁদে লেগে যায়। সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকা আলোয় আলো জ্বলে ওঠ। ভারতীয় সেনাদের দেখে ফেলে বাঙ্কারে থাকা পাক সেনারা। প্রহরারত এক পাকসেনা চেঁচিয়ে উঠতেই শুরু হয় গুলির লড়াই। বছর আটাশের ল্যান্স নায়েক এক্কা এগিয়ে গিয়ে বাঙ্কারে থাকা পাক বাহিনীর জওয়ানদের খতম করেন। এলবার্ট এক্কা তার সঙ্গী ল্যান্স নায়েক গোলাব সিং, মেজর কোহলি সহ দুই কোম্পানির মোট ২৪০ জন জওয়ান পাকসেনাদের পরাস্ত করে একের পর এক বাঙ্কারের দখল নিতে থাকেন। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে যুদ্ধ করার সময় পাক বাহিনীর ছোড়া একটি গুলি এলবার্ট এক্কা'র বাঁ হাতে লাগে। তারপরও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই অবস্থায় আরো একটি গুলি এসে লাগে এলবার্ট এক্কার গলায়। তিনি মাটিতে পড়ে যান কিন্তু দমে যাননি। উঠে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেন রেলের উচু সিগন্যাল রুম থেকে ভারতীয় সেনা বাহিনীর দিকে গুলি ছুটে আসছে। তখন তিনি সিগন্যাল রুম লক্ষ্য করে উপরের দিকে গ্রেনেড ছোড়েন। গ্রেনেডে একাধিক পাকসেনার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। কিন্তু নিজের ছোড়া গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে গুরুতর জখম হন এলবার্ট এক্কা। তার শরীরের অঙ্গপ্রতঙ্গ বেরিয়ে যায়। এই অবস্থায় তিনি লক্ষ্য করেন, এক পাক সেনা সিগন্যাল রুম থেকে ভারতীয় জওয়ানদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। নিজের ক্ষত স্থান চেপে ধরে লোহার সরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে শেষ পাক সেনাটিকে বধ করে নিচে নামার সময় শহীদ হন।
মানস পাল বাংলানিউজকে জানান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩রা ডিসেম্বরে ভারতীয় বাহিনী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে সাফল্য পায়। এই সাফল্যের পেছনে যারা বড় ভূমিকা রেখেছিলেন তাদেরই একজন ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কা।
সেই রাতে এলবার্ট এক্কার পাশাপাশি আরো ১১জন ভারতীয় বীর জওয়ান শহীদ হন। এরা হলেন গোলাব সিং, কাশীনাথ সাহু, ডেভিড টিগ্যা, মার্গ গিয়াত সিং, উবাও সিং, রামদেও সাহু, কেশর দেব, দাল সিং, যোসেফ টোপনো, শিব নারায়ণ ও দূর্গা প্রসাদ। সেই রাতে প্রায় সব পাকসেনাকে খতম করতে সক্ষম হয়েছিলেন ভারতীয় বাহিনীর জওয়ানরা। এই অভিযান শেষ হতে হতে দিনের নতুন আলো ফুটে ওঠে।
পরে শহীদ ভারতীয় জওয়ানদের আগরতলার বাধারঘাটের শ্রীপল্লী এলাকায় সমাধিস্ত করা হয়। এখানে একটি স্মৃতিসৌধ বানানো হয়েছে তাদের স্মৃতির উদ্যেশে।
ওই রাতের লড়াইয়ে পাক বাহিনীর মনোবল একেবারে ভেঙ্গে যায়। তারা সম্মুখ সমরে আগরতলা আক্রমণের পরিকল্পনা থেকে পুরোপুরি সরে দাঁড়ায়। পরবর্তীকালে পাকবাহিনী যুদ্ধবিমান ও কামান থেকে গোলা ছুড়ে আগরতলায় ক্ষয়ক্ষতির চেষ্টা করলেও সরাসরি আক্রমণের সাহস করেনি।
অসীম সাহসের জন্য ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কাকে ভারত সরকার সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ সম্মাননা পরমবীর চক্র প্রদান করে। এক্কা'র বাড়ি ভারতের বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজধানী রাঁচী শহরের পাশে গুমলা ব্লক এলাকায়। রাঁচী শহরের একটি জায়গায় এক্কার একটি মূর্তি বসানো আছে। জায়গাটি এলবার্ট এক্কা চক নামে খ্যাত। ভারত সরকার এলবার্ট এক্কার নামে ডাক টিকিটও প্রকাশ করেছে। একটি ব্লকের নামকরণও করা হয়েছে তার নামে। তার স্ত্রী বালমাডিন এক্কা ও ছেলে ভিনসেন্ট এক্কা গত বছর আগরতলা এসে এলবার্ট এক্কার স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে গেছেন।
ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কার সাহসী ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ সরকারও তাকে "ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার" সম্মাননায় ভূষিত করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৭
এসসিএন/জেএম