জানা গেছে, জুমের বিশেষ প্রজাতির পরিপক্ষ লাউয়ের খোলস এবং ছোট ছোট বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় বিশেষ এই বাঁশি রসেম। মূলত পাহাড়ি অঞ্চলের ডার্লং জনজাতি অংশের মানুষ তাদের নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এই বাঁশি বাজিয়ে থাকেন।
বর্তমানে থাঙ্গা ডার্লং ত্রিপুরা রাজ্যের মাত্র একজন ব্যক্তি যিনি এই বাঁশি তৈরি করার পাশাপাশি বাজাতে পারেন। তার বাড়ি ঊনকোটি জেলার মুরাইবাড়ী এলাকায়। তার এই বিশেষ প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ গত ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মাননা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন।
থাঙ্গা ডার্লং’র এই অনন্য গৌরব অর্জনে খুশির হাওয়া বইছে পুরো ত্রিপুরা রাজ্যজুড়ে। খুশি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবও। পদ্মশ্রী পাওয়ার ঘোষণায় ত্রিপুরায় নিজ সরকারি বাসভবনে নিমন্ত্রণ জানিয়ে থাঙ্গাকে সংবর্ধনা দেন বিপ্লব কুমার।
সোমবার (২৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় আগরতলায় মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে এলে রিশা ও ফুলের তোড়া দিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয় থাঙ্গা ডার্লংকে। সংবর্ধনা নিতে খালি হাতে আসেননি থাঙ্গা নিজেও। মুখ্যমন্ত্রীর জন্য উপহার হিসেবে এনেছেন নিজ হাতে বানানো রসেম। রসেম পেয়ে সরস মুখ্যমন্ত্রী বাজানোর চেষ্টাও করেন বাঁশিটি।
মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) আগরতলার সার্কিট হাউসে বসে বাংলানিউজকে দেওয়া এক একান্ত স্বাক্ষাতকারে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন থাঙ্গা ডার্লং। তিনি জানান, ১৯২০ সালের ২০ জুলাই মুরাইবাড়ীতে তার জন্ম। প্রথমে তার বাবার কাছে রাসেম বাজানো ও তৈরি করা শিখেছেন। পেশায় তিনি জুমিয়া। প্রতিদিনের কাজ সেরে নিজের ঘরে বসে আপন মনে এই বাঁশি বাজান। এটি বাজাতে খুব দম লাগে তারপরও তিনি কম করে এক ঘণ্টা বাজাতে পারতেন। তবে এখন বয়সের কারণে বাজাতে পারেন না দীর্ঘ সময়।
তার এই বাঁশির খ্যাতি ছড়িয়েছে দেশ ছেড়ে বিদেশেও। ২০০২ সালে জাপান সরকারের নিমন্ত্রণে সেদেশে যান ডার্লং। দুই মাস সেখানে থেকে বাঁশি তৈরি ও বাজানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ শতভাগ শিখতে পারেনি এবং সঠিকভাবে তৈরিও করতে পারেনি। এই বাঁশি বাজানোর আমন্ত্রণ পেয়ে বাংলাদেশও সফর করেছেন দুইদিনের জন্য। তবে সালটা এখন আর মনে করতে পারছেন থাঙ্গা। ২০১৫ সালে সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ তাই চলাফেরা করতে কষ্ট হয়, এমনকি গলার আওয়াজও কমে এসেছে। কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলেন। জীবনের শেষ বয়সে এসে এমন সম্মাননা পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি।
ডার্লং এর জুমিয়া পরিবারে আর্থিক অনটন লেগেই আছে। এই অবস্থায় সরকারি সহায়তা পেলে ভালো হতো বলে মুখ্যমন্ত্রীকে জানান তিনি। মুখ্যমন্ত্রীও আশ্বাস দিয়ে জানান, তার ত্রাণ তহবিল থেকে এককালীন দেড় লাখ রুপি আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে তাকে। পাশাপাশি নাতনিকে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুসারে সরকারিভাবে সহায়তা করা যায় কিনা এই বিষয়ে চেষ্টা করা হবে বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রীর আতিথেয়তা এবং মহানুভবতায় মুগ্ধ থাঙ্গা ডার্লং বলেন, আমি এক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য সুদে ৪০ হাজার রুপি নিয়েছিলাম। এর মধ্যে সুদসহ ২০ হাজার রুপি ফেরত দিলেও বাকি ২০ হাজার রুপি ফেরত দিতে পারিনি। মুখ্যমন্ত্রীকে বিষয়টা জানানোর পরপরই সেদিন নিজ পকেট থেকে বাকি রুপি আমার হাতে তুলে দেন ঋণ মিটিয়ে দেওয়ার জন্য।
ত্রিপুরা রাজ্যে তার মতো আরও একজন রসেম শিল্পী কেন তৈরি হলো না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটি বাজানো খুব কঠিন। একসঙ্গে সাতটি বাঁশি রয়েছে এতে। দীর্ঘ অনুশীলনের পর এটি রপ্ত করা যায়। আর তৈরি করাও অনেক কঠিন। সব নিয়ম মেনে তৈরি করতে এর মধ্যে রয়েছে বাঁশের আকার, লম্বা, বাঁশের বয়স, প্রজাতি ইত্যাদি। শুধু তাই নয় লাউয়ের ভেতরে বাঁশের যে অংশ থাকে এগুলিও বিশেষ মাপ রয়েছে। এতে লাগাতে হয় পিতলের পাত। কথা বলতে বলতে বাঁশি খুলে নিজেই দেখালেন এই সব সরঞ্জামগুলি। এসকল কারণে দেশ-বিদেশের কেউ নিখুঁতভাবে এটি তৈরি ও বাজানো শিখতে পারেনি বলে মনে করেন থাঙ্গা। তবে নিজের জনগোষ্ঠীর কয়েকজন এই বাঁশি তৈরি ও বাজানো কিছুটা শিখেছে।
এই বাঁশির নাম রসেম হলো কি করে এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ডার্লং ভাষায় ‘র’ মানে বাঁশ, বাঁশ দিয়ে তৈরি তাই এর নাম রসেম।
৯৯ বছর বয়সে লাঠি নিয়ে চলাফেরা করলেও থাঙ্গার স্বপ্ন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণের।
বাংলাদেশ সময়: ০৫০৮ ঘণ্টা, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৯
এসসিএন/আরআর