উড়ির চর, (চট্টগ্রাম/নোয়াখালী) থেকে ফিরে: সাগর-নদীর অবারিত জলরাশি বেষ্টিত ছোট জনপদ ‘উড়ির চর’। জোয়ার-ভাটায় তাল মিলিয়ে চলে এখানকার জীবন।
সুদিন ফিরলেও সংকট এখনও অনেক। চারদিকেই পানি হওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, দুই জেলার মধ্যে সীমানা বিরোধ ও নদী ভাঙ্গনের মতো সমস্যা টেনে ধরেছে চরের অগ্রগতি। ধান, সবজি, মাছ ও কাঁকড়ায় সমৃদ্ধ এই চরের বর্তমান চিত্র দেখে এসে লিখেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সোলায়মান হাজারী ডালিম। ৬ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ৪র্থ পর্বে থাকছে চিকিৎসার অপ্রতুলতার কথা।
তখন রাত ১০টা। পুরো উড়ির চরে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। সন্ধ্যায় জেনারেটরের আলোয় হাট-বাজারে কিছুটা আলো থাকলেও রাত বাড়তে বাড়তে সব আলো নিভে অন্ধকার প্রগাঢ় হতে থাকে। হঠাৎ করে প্রসব বেদনা উঠে জরিনা বেগমের (৩৫)। গ্রামের ওষুধ দোকানিকে খবর দেওয়া হলো। তিনি এসে ওষুধ দেওয়ার পর হিতে-বিপরীত হলো। ব্যথা আরও তীব্র হতে থাকলো। এমন ব্যথা কোনোভাবেই সহ্য হচ্ছিল না ওই নারীর। জরিনার ছটফটানো দেখে স্বজনরা ছুটলেন শহরের বড় হাসপাতালে নিতে। খবর দিলেন নদীর ঘাটে। সেখানে কোনো নৌকা নেই। চরের অপর প্রান্তের ঘাটেও কোনো নৌকা নেই।
উপায় না পেয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে রইলেন স্বজনরা। অসহ্য যন্ত্রণা সইতে না পেরে রাত দুইটার দিকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা জরিনা।
চরের জনতা বাজারের শাহাদাত টেইলার্সের মাইন উদ্দিন বলছিলেন, ‘শুধু যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণেই বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়েছে তার মাকে’।
মাইন উদ্দিন বলেন, ‘মানুষের বাঁচা-মরাতো আল্লাহর হাতে, একটু চিকিৎসা করাতে পারলে মনে সান্ত্বনা হয়, আমরা সেটাও করতে পারিনি। বিনা চিকিৎসায় হারিয়েছি মাকে।
বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উড়ির চরের এমন ঘটনা একটি দুটি নয়, অহরহ। এখানে চিকিৎসাসেবা খুবই অপ্রতুল। চিকিৎসা নিতে হলে দৌঁড়াতে হয় নোয়াখালী কিংবা চট্টগ্রাম শহরে। তা নির্ভর করে জোয়ার-ভাটা এবং নৌকা পাওয়ার ওপরে।
চরের জনতা বাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুরউদ্দিন বলেন, তার অভিজ্ঞতার কথা। গেল দুই বছর আগে তার বোন রুমা আক্তারে হঠাৎ করে প্রসব বেদনা উঠে। রাত হয়ে যাচ্ছে ব্যথাও বাড়ছে। সবাই কান্নাকাটি করছে। মাথার মধ্যে চিন্তা ভর করছে বোনকে কী বাঁচাতে পারব না। ঘাটে খবর দেওয়া হলো। এরপর কোনো মতে একটি নৌকা পেলেও সেটি পর্যন্ত যেতে হলে কাঁদা পথে হাঁটতে হবে ২ কিলোমিটার। কোনো উপায় না পেয়ে একটি স্ট্রেচার জোগাড় করে ধরাধরি করে, কোলে নিয়ে বোনকে নৌকাতে তোলা হয়। নৌকা থেকে নামিয়ে নোয়াখালীতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিজারিয়ান করে বাচ্চা প্রসব করানো হয়। ডাক্তার বলেছিলেন আর একটু দেরি হলে বাচ্চা এবং মা দুইজনেরই জীবন ঝুঁকিতে ছিল। বাচ্চাটি প্রসব হলেও পুরোপুরি সুস্থ ছিল না।
মোহাম্মদ নুরউদ্দিন বলেন, বাচ্চা এবং মাকে হাসপাতালের স্পেশাল কেয়ারে রাখতে হয়েছে ১ সপ্তাহ।
তিনি আরও জানান, চরের আলতাফ ড্রাইভারের মা মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন। নৌকা না পাওয়ায় চরের বাইরে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বিনা চিকিৎসায় তিনিও মারা গেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা সাইফুল ইসলামের স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, ‘তার দুই সন্তান, কোনো সন্তানের সময়ই কোনো ডাক্তার দেখাতে পারেননি। দুই সন্তানের প্রসব করেছে গ্রামের ধাত্রী।
শারমিন জানান, এসব ধাত্রীর অবহেলায় অনেক নারী প্রাণ ঝরে গেছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। উড়ির চরে ডাক্তারতো দূরের কথা, একটা নার্সও নেই।
উড়ির চরের ৪০ হাজারের বেশি বসবাসকারীর জন্য একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও সেখানে নেই কোনো ডাক্তার, নার্স । যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি আছে তাতে ডাক্তার নেই- আছে পুলিশ। ২০০২ সালে চরের অধিবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে নির্মাণ করা হয় একটি পরিবার কল্যাণকেন্দ্র (এফডব্লিউসি)।
তিনতলার এ কেন্দ্রের দোতলায় যেখানে আউটডোর রোগীদের বসার কথা সেখানে এখন পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের খাবারের ব্যবস্থা। দোতলায় একটি এমবিবিএস ডাক্তারের কক্ষ থাকলেও সেখানে বসেন একজন উপ-সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির একটি কক্ষ ব্যতীত সম্পূর্ণ ভবন পুলিশ ফাঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
উড়িরচর পরিবার কল্যাণকেন্দ্রে একজন এমবিবিএস ডাক্তার, একজন উপ-সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, একজন পরিদর্শক, একজন নার্স ও এমএলএসএসসহ মোট পাঁচটি পদে লোক থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে আছে শুধু একজন। উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মিঠুন চন্দ্র দে একাই সব সামলান।
এই বিষয়ে সন্দ্বীপ উপজেলার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আবদুল মতিন বলেন, উড়িরচর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন উপ-সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বাকি পদগুলো শূন্য। হাসপাতালের যে ভবনটি আছে সেটিও ব্যবহার করে পুলিশ। ভবনের একটি রুমে বসতে পারে উপসহকারী মেডিকেল অফিসার। বাকি সবগুলো রুম ও প্রাঙ্গণ ব্যবহার করছে পুলিশ।
ডা. মো. আবদুল মতিন আরও বলেন, যেহেতু এই দ্বীপ থেকে তাৎক্ষণিক মানুষকে চিকিৎসার জন্য নেওয়ার ব্যবস্থা নেই, সেকারণে এখানকার মানুষদের নির্দেশনা দেওয়া থাকে আগেই যেন শহরে পৌঁছে যায় কিংবা যাতায়াতের ব্যবস্থা করে রাখে।
স্থানীয়রা জানান, পুরো দ্বীপে ডাক্তার এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় ট্রলারে করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে চিকিৎসার অভাবে অকালে মারা যান অনেক রোগী।
উড়িরচর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণকেন্দ্রের উপসহকারী মেডিকেল অফিসার মিঠুন চন্দ্র দে বলেন, প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী হাসপাতালটিতে আসে। সাধ্যমত সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। যন্ত্রপাতি ও লোকবলের অভাবে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পুলিশ ফাঁড়ি থাকার ব্যাপারে উড়িরচর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ শাহীন বলেন, এখানে ফাঁড়ির জন্য কোনো ভবন নেই। কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে এখানে ফাঁড়ি করা হয়েছে। এক সঙ্গে এখানে হাসপাতালের কাজও চলে। পুলিশ ফাঁড়ির জায়গার নামজারি হওয়ার পর ফাঁড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হতে পারে।
স্থানীয়রা জানান, উড়ির চরে সরকারি চিকিৎসাসেবা খুবই অপ্রতুল। যে হাসপাতালটি আছে সেটি থেকেও নেই। কোনো এমবিবিএস ডাক্তারের সেবা এই দ্বীপের মানুষ পায় না। এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপতাল প্রয়োজন। ২০ শয্যার একটি হাসপাতাল হলেও এখানকার মানুষ চিকিৎসা পাবে। বিপদকালীন এ দ্বীপের জন্য একটি ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স এখানকার মানুষের যৌক্তিক দাবি।
আরও পড়ুন>>>
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০২২
এসএইচডি/এএটি