পাথরঘাটা (বরগুনা): পশ্চিমে বলেশ্বর, আগের বিষখালী নদী আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। ঠিক মধ্যখানে উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটা।
প্রতিবছর চৈত্রের খরায় খাল, পুকুর ও দিঘি শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। পাথরঘাটার দক্ষিণ পদ্মা থেকে উত্তরে পিপুলিয়া গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র পানি সংকটের চিত্র চোখে পড়ে। এ যেন ‘পানির দেশেও সুপেয় পানির জন্য লাইন’, উপকূলে এমন কথা হাস্যকর হলেও এটিই এখানকার বর্তমান বাস্তবতা। এক কলসি পানি সংগ্রহের জন্যে নারী-পুরুষ আর শিশুদের ছুটতে হয় সেই সকাল থেকে। এক সময় শুধু দক্ষিণ উপকূলের পানি সংকটের খবর পাওয়া গেলেও এ সংকট ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়েছে উপকূলজুড়ে।
এখানে শুধু সুপেয় পানির অভাব এমনটাই নয়, পানিশূন্যতা, লবণাক্তসহ নানা চর্মরোগসহ দূর থেকে পানি আনায় শারীরিক বিভিন্ন ঝুঁকিও আছে, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে।
শুকনো আর ভরা মৌসুম এখানে সমান। তাছাড়া পাথরঘাটায় গভীর নলকূপ না বসায় এখনকার মানুষের দুঃখের শেষ নেই। এছাড়াও পাথরঘাটা পৌর শহরের অবস্থা আরও নাজুক। তবে উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের বাসিন্দাদের বন্ধু হয়ে পানির কষ্ট দূর করছেন বন্ধু ফাউন্ডেশন। সদর ইউনিয়নসহ উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে সুপেয় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে নামমাত্র মূল্যে। এখানকার বাসিন্দাদের মতে, দুঃসময়ে বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে বন্ধু ফাউন্ডেশন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে কিলোমিটার পাইপ দিয়ে পানি সরবরাহ করছে এ সংগঠনটি।
চরলাঠিমারা, বাদুরতলা, পদ্মা, নিজলাঠিমারা গিয়ে দেখা গেছে পানির সংকট আর পানির জন্য হাহাকারের দৃশ্য। কিছুদিন আগেও এক কলসি পানির ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে আনতে হতো। কিন্তু এখন সেই পানি মানুষের দোরগোড়ায় হলেও দীর্ঘলাইন। এক কলসি পানি নেওয়ার জন্য আগে থেকেই খালি কলসি লাইনে রেখে যায়। পানির সংযোগ ছাড়তেই কলসির লাইনে দাঁড়িয়ে যায় মানুষ।
বাদুরতলা গ্রামের সেলিম, ফারুক, ইলিয়াস, ইব্রাহিম, কোহিনুরের মতো অসংখ্য মানুষ এক কলসি পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এমনকি শিশুরাও পানি নিতে আসে।
বাদুরতলা গ্রামের সেলিম বলেন, প্রতিদিন বিকেলে চার কিলোমিটার দূরে একটি খাস পুকুর থেকে পানি আনতে হতো। এখন নিকটে পানি পেলেও দৈনিক এক কলসির বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আগের চেয়ে কিছুটা দুর্ভোগ কমলেও পানির সংকট কাটেনি।
চরলাঠিমারা গ্রামের আবুল ফরাজির বলেন, চারিদিকে থই থই পানি থাকলেও লবণ পানির কারণে দুর্বিষহ অবস্থা।
প্যাডেল ভ্যান, রিকশা আর বাইসাইকেলে করে মিঠা পানি আনতে হয় দূর থেকে। আবার চৈত্রের খরায় পুকুরগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় এ অবস্থা আরও দুর্বিষহ অবস্থায় পরিণত হয়।
একই গ্রামের বেলায়েত হোসেন বলেন, গ্রামে ভালো পানির পুকুরের সংখ্যা কম। তাই পানি সংগ্রহের জন্য লড়াই শুরু হয় ভোর থেকেই।
জানা গেছে, পাথরঘাটা পৌরবাসীর জন্য একটি মাত্র সাপ্লাই পানি সরবরাহ করা হয়। তাও আবার ১২ কিলোমিটার দূর থেকে আনা হয়। কখনো কখনো ওই পানিও ঘোলা, অপরিষ্কার, পোকামাকড় থাকায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পরে।
পৌরসভায় ১৭টি ফিল্টারের মধ্যে ১২টি সচল থাকলেও পাঁচটি অকেজো। এর মধ্যে সবচেয়ে পৌর শহরের একটি রিজার্ভ পুকুরে পানির ওপর নির্ভরশীল কয়েক হাজার মানুষ। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে পুকুরটি অরক্ষিত।
সম্প্রতি একটি গবেষণার তথ্যে দেখা যায়, পাথরঘাটা উপজেলার ৪৬টি গ্রামে খাবার পানির চরম সংকট। গ্রামগুলোর বিশুদ্ধ পানির উৎসের বেশির ভাগই অকেজো। ফলে কয়েক বছর ধরেই তারা শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির সংকটে পড়ছেন।
এর মধ্যে সুপেয় পানির বেশি সংকট ২৫টি গ্রামে। এর বাইরে উপজেলার আরও ২১টি গ্রামের বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির মাঝারি মাত্রার সংকট রয়েছে।
সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের গবেষণার তথ্যে উপজেলার ৪৬ গ্রামে সুপেয় পানির উৎসগুলোর ৬০ শতাংশই এখন অকেজো। এতে বিশুদ্ধ পানির সংকটে রয়েছে কয়েক হাজার পরিবার।
বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার বিপুল চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, পাথরঘাটায় পানি থেকেও সুপেয় পানির সংকট। মানুষের হাহাকারের কথা চিন্তা করে সুপেয় পানি উপকূলের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছি। আমরা পাথরঘাটায় ১০টি প্লান্টের মাধ্যমে প্রতিদিন ২ লাখ ৪০ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। যা প্রতিদিন ৩ হাজার পরিবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়।
এদিকে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, গত অর্থবছরে উপজেলায় ৬৭টি মিঠা পানির পুকুর পুনঃখনন করা হয়েছে। উপজেলায় সুপেয় পানির জন্য পণ্ড স্যান্ড ফিলটার (পিএসএফ) রয়েছে ৬১টির মধ্যে ৬টি অকেজো থাকলেও বাকিগুলো সচল। এর মধ্যে ৩০টি ফিলটার সোলারের মাধ্যমে চলে। এছাড়াও পাথরঘাটায় রিভার্স অসমোসিস (আরও) প্রকল্পের আওতায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট রয়েছে ৩টি।
অপরদিকে, বন্ধু ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী পাথরঘাটা উপজেলায় ১০টি প্লান্ট থেকে প্রতিদিন ২ লাখ ৪০ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। যা একেকটা প্লান্ট থেকে ২৫টি করে পানির কল দেয়া হয়েছে। একেকটা কল থেকে ১০ থেকে ১৫ পরিবারের পানির চাহিদা মেটায়। যা মাসে পরিবার প্রতি ২০ টাকা দিতে হয়। এ থেকে উপজেলায় প্রতিদিন ৩ হাজার পরিবার পানি পাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, এ উপজেলায় গভীর নলকূপ না বসায় পানির সংকট থাকে। বিশেষ করে চৈত্রের খরায় আরও তীব্র হয়। মিঠা পানির পুকুরগুলো পুনঃখনন এবং সোলারের মাধ্যমে ফিলটার গুলো সচলের কারণে অনেকাংশে পূরণ হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, পুকুর, খাল ও নদী থেকে ভূ- উপরস্থ পানি পরিশোধনাগারের মাধ্যমে রিফাইন করে সরবরাহ করলে এ সংকট স্থায়ীভাবে দূর করা সম্ভব।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রোকনুজ্জামান খান বলেন, পাথরঘাটা উপকূলে সর্বত্র সুপেয় পানির সংকট থাকবেন সারা বছর ধরে। পানির চাহিদা মেটাতে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারিভাবে ভূমিহীনদের আবাসনে পানির সংকট আরও তীব্র ওইসব আবাসনগুলোতে সুপেয় পানির ব্যবস্থার জন্য আমাদের তা চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২৪
এএটি