পাথরঘাটা, (বরগুনা): বয়স তিন বছর পেরিয়েছে সালমানের। অনেক কিছুই বুঝতে শুরু করেছে সে।
মো. ইউসুফ, হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তি। এলাকায় ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। চাকরি করতেন কিন্ডার গার্টেনে। পাশাপাশি মাছ ধরা ট্রলার ছিল তার। শখের বসে নিজের ট্রলারে জেলেদের সাথে সাগরে গিয়েছিলেন। কে জানতো এই যাওয়াই যে শেষ যাওয়া কেউ বুঝতে পারেননি। আর ফিরে আসবে না পরিবারের কেউ কল্পনাও করেননি।
ইউসুফ সাগরে যাওয়ার দিন ঘুমের ঘোরে ছোট সন্তান সালমানের দুই গালে চুমু দিয়ে চলে যান জীবিকার সন্ধানে সাগরে। কিন্তু সালমানকে দেওয়া বাবার এই আদর যে শেষ আদর হবে তা কি কে বুঝতে পেরেছিল।
শখের বসে প্রথম সাগরে যাওয়ার সময় স্ত্রী শারমিন আক্তারকে বলে গিয়েছিলেন সাগর থেকে এসে মেয়ে সুমাইয়া আক্তারের (৮) বার্ষিক পরীক্ষা। এরপর তাকে জামা কিনে দেবে। কিন্তু সেই আশাও পূরণ হলো না, আশা নিরাশা আর বিষাদে পরিণত হয়েছে।
২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর সাগরে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে নিখোঁজ হন বরগুনার ২৫ জেলে। এরমধ্যে পাথরঘাটার ১১ জন নিখোঁজ রয়েছেন, তারা হলেন- এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের আবুল কালাম, মো. জাফর মিয়া, মজিবুর রহমান, ইউসুফ মিয়া, ছত্তার হাওলাদার, নাদিম, বেল্লাল ও ইয়াছিন মিয়া। এফবি তামান্না ট্রলারের আউয়াল বিশ্বাস, সফিকুল ইসলাম, মো. ফারুক, আব্দুল খালেক, মো. নান্টু মিয়া, মো. মাহতাব, সিদ্দিক মৃধা, কালু মিয়া, মো. মনির হোসেন, সহিদুল ইসলাম, মো. সুবাহান খাঁ, মো. ইউনুস সর্দার, মো. খলিল, আব্দুর রব, মো. আল আমিন, মো. লিটন, মো. কালাম।
সরেজমিন পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নে বড় টেংরা গ্রামের জেলেপল্লিতে গিয়ে দেখা গেছে, স্বজনহারা আর্তনাদ। সাড়ে চার মাস অতিবাহিত হলেও আজ পর্যন্ত সন্ধান মেলেনি। পাথরঘাটার ১১ পরিবারেই এমন আর্তনাদ।
কথা হয় নিখোঁজ ইউসুফের স্ত্রী শারমিন আক্তারের সাথে। শেষ কথা কি হয়েছে জিজ্ঞেস করা মাত্রই ফ্যাল ফ্যাল করে কেঁদে দিলেন। বলেন, মাইয়া-পোলা দুইডা সারাদিন বাবার কথা জিগায় কিছু কইতে পারি না। সামনে ঈদ, ওগো জামা-কাপড় দিতে পারি নাই'।
তিনি আরও বলেন, যখনই বাবার কথা মনে পড়ে তখনই নিজের খেয়ালেই আকাশে দিকে হাত দুটো উঁচু করে বাবাকে ডাকছে, ‘বাবা, বাবা, আব্বা, আব্বা’। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই কান্না শুরু করে সালমান। বলে আমার আব্বারে আইন্না দাও, আব্বায় ঈদের নতুন জামা লইয়া আয় না ক্যান, এসব কথা বলে মায়ের কাছে বার বার প্রশ্ন করছে নিখোঁজ ইউসুফ আলীর তিন বছরের ছেলে সালমান। কিন্তু কি জবাব দেবে অসহায় মা শারমিন আক্তার। শুধু মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন তিনি।
সাংবাদিকদের কাছে শারমিন জানান, ঘরে ভাত রান্দার (রান্না করার) কিছু নাই। ক্যামনে দিন কাটে, তা আল্লায় জানে। ঈদ তো দূরের কথা, আমার স্বামী কোথায় আছে, সেই খবরও এখনো কেউ আইন্না (এনে) দিল না।
ইউসুফের ছোট ভাই ইয়াকুব আলী বলেন, অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি আজও ভাইকে পাইনি। জীবিত আছে না মারা গেছে তাও বুঝতে পারছি না। ভাইয়ের দুই সন্তানের মুখের দিকে তাকাতে পারি না, বাবাহারা সন্তানের আর্তনাদ, শান্তনা দেওয়ার মতো সাধ্য নেই। অপরদিকে সন্তানহারা বাবা-মাও সন্তানের আশার অপেক্ষা প্রহর গুনছে। পথপানে চেয়ে থাকে এই বুঝি বড় ছেলে ইউসুফ আসছে।
উপকূল অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও গবেষক শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, কারো সন্তান, কারো বাবা, কারো জোড়ের ভাই হারানোর আর্তনাদ উপকূলের মানুষের সব সময়েই। প্রতিনিয়ত এখানকার মানুষের স্বজনহারা কষ্ট নিয়ে বাস করছেন। এমন জীবিকার কাজ করছেন যে 'সাগরে যতবার যাওয়া, ততবার চিরবিদায় নেওয়ার মতো। শেষ যাওয়া মনে করেই জেলেরা পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান প্রশংসনীয়, এত অবদান সত্বেও উপকূলের জেলেদের নিয়ে কেউ ভাবছেন না, ভাবার সময়ও নেই। উপকূলীয় অঞ্চলের জীবন-জীবিকা, উপকূলের সম্পদ, জলবায়ু, পরিবেশসহ জেলেদের নিরাপত্তা নিয়ে উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড এবং উপকূল মন্ত্রণালয়ের দাবি করছি।
পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রোকনুজ্জামান খান বলেন, উপকূলের জীবন-জীবিকা, জেলেদের নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে। প্রতিনিয়ত পরিবার হারাচ্ছে উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। সবশেষ নিখোঁজ পরিবারে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঈদকে সামনে রেখে কিছু সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০২৪
এএটি