পাথরঘাটা (বরগুনা): উপকূলীয় উপজেলা বরগুনা জেলার পাথরঘাটা। যার পশ্চিমে বলেশ্বর নদ সংলগ্ন সুন্দরবন, পূর্বে বিষখালী নদী ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
উপকূলের জীবন-জীবিকা চিত্র দু'চোখ না দেখলে বুঝা যাবে না। হাজার হাজার মানুষ নদী ও সাগরে মাছ শিকার করে। হাশেম খলিফার মতো অসংখ্য প্রান্তিকজন দিনরাত পরিশ্রম করে জীবনের চাকা ঘুরাচ্ছেন। উপকূলবাসীর বিশেষ করে জেলেদের জীবনের চাকা জোয়ার-ভাটার ওপর হলেও হাশেম খলিফার জীবনের চাকা ভিন্ন। বলেশ্বর নদের পাড়ে অপেক্ষা যেন শেষ হয় না। কখন জোয়ার এসে ভাটা লাগবে। ভাটা হলেই হাশেমের জীবিকার সন্ধান শুরু। প্লাস্টিকের বোতল কুড়ানো শুরু হয়ে যায়।
হাশেম খলিফা, বয়স ৯৫ বছর। মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এ বয়সে তার শরীরে এমন কাজ সহ্য হয় না। তারপরেও পেটের দায়ে কাজ তো করতেই হবে। রোদ, বৃষ্টি আর ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এ যেন সবই তার কাছে সমান। এ বয়সে বিশ্রাম নেওয়ার কথা কিন্তু প্রখর রোদেও প্লাস্টিকের বস্তা নিয়ে নেমে পড়েন বলেশ্বর নদ পাড়ে।
বাংলানিউজ ছুটে চলে প্রান্তিকের জীবন-জীবিকাসহ তাদের গল্প কথা শুনতে; লিখে যাচ্ছে এসব মানুষদের দুঃখগাথা চিত্র। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলানিউজের এ প্রতিবেদক ছুটে চলে বলেশ্বর নদের বেড়িবাঁধ দিয়ে। ঠিক দুপুর ১২টা। প্রখর রোদ, মাথার উপরে যেন সূর্য হেলে পড়েছে। এমন সময় দেখা হয় ৯০ বছরের হাশেম খলিফার সঙ্গে। দুই হাতে দুইটি বাঁশের লাঠি। কাঁধে ভারী একটি বস্তা। দূর থেকে মনে হয়েছে মানসিক ভারসাম্যহীন কেউ হতে পারেন। কাছে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। শুধু তাই নয় তার উপার্জনের পথও ভিন্ন। দুই হাতে দুই লাঠি যার একটি হচ্ছে বার্ধক্যের সহযোগী অন্যটি প্লাস্টিকের বোতল কুড়ানোর সহযোগী। গভীর সমুদ্র থেকে এবং নদী থেকে জোয়ারের সঙ্গে ভেসে আসা প্লাস্টিকের বোতল যা ভাটায় নদীর পাড়ে বিভিন্ন জায়গায় আটকে থাকে সেগুলো কুড়িয়ে যা পান তা বিক্রি করে।
কথা হয় হাশেম খলিফার সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় শুনেই চমকে গেলেন তিনি। তিনি বলেন, কৃষি জমি নেই, বাড়ির যতটুকু জমি ছিল তার অর্ধেক ওয়াপদায় নিয়ে গেছে। যা আছে সেখানেই কুড়ে ঘরে বসবাস করেন। তিন মেয়ে বিয়ে হয়েছে তাদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত একমাত্র ছেলেও টানাপোড়েন চলে সংসার।
হাশেম বলেন, প্রতিদিন জোয়ার হলেই নদীর পাড়ে এসে ভাটার অপেক্ষায় থাকি। যখন ভাটা হয় তখন জোয়ারে ভেসে আসা প্লাস্টিকের বোতল টোকাই। যা পাই তা বস্তায় ভরে বাড়িতে নিয়ে রাখি। তিন-চার দিন পর পর বিক্রি করি। এগুলো মান বুঝে ১০-৪০ টাকা পর্যন্ত কেজি বিক্রি করি। এ কাজ করছি আট বছর ধরে। তার আগে নদীতে মাছ ধরতাম। এখন বয়স হয়েছে, শরীরে আর কুলায় না। বুড়া-বুড়ি থাকি। বয়স্ক ভাতা পাই। কোনো মতে দিন যায়। হাতে দুইটি লাঠি কেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, একটি লাঠির ভরে হাঁটাচলা করি, অন্যটি দিয়ে বোতল কুড়াতে সাহায্য নেই। রোদ-বৃষ্টিতে সমানতালে বোতল টোকাই।
এই বয়সেও এসে এমন কাজ করছেন কেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, গরীব মানুষ, বাপ-দাদার জমি নদীতে চলে গেছে। ওয়াপদার পাশে একটি কুড়ে ঘরে থাকি। শরীরে আর কুলায় না, এজন্য এ কাজ বেছে নিয়েছি। কাজ না করলে খামু কি!
চরদুয়ানী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান জুয়েল বাংলানিউজকে বলেন, হাশেমের মতো অসংখ্য বৃদ্ধ এ কাজ করছেন। এ এলাকা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। তবে এমন বয়সীর মানুষের কাজ ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও বাধ্য হয়েই পেটের দায়ে কাজ করতে হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০২২
এসআরএস