ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

করাতকল-ইটভাটা, গিলছে সংরক্ষিত বন

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৪
করাতকল-ইটভাটা, গিলছে সংরক্ষিত বন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চরমোন্তাজ, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী ঘুরে এসে : নিয়ম নেই, তারপরও সংরক্ষিত বনের আশপাশেই করাতকল, ইটভাটা। করাতকলে দেদারছে চেরাই হচ্ছে বনের গাছ।

ইট বানাতে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। দুই ঘাতক মিলে গিলছে সংরক্ষিত বন। যে বন রক্ষায় সরকারের এত আয়োজন, সেই বন এভাবেই নজরদারি অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

উপকূলে জেলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজ ঘুরে এমন তথ্য মিলেছে। একই চিত্র পাওয়া গেছে একই জেলার কলাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে।

বন বিভাগের নীতিমালায় রয়েছে, সংরক্ষিত বনের তিন কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপন করা যাবে না। করাতকল চালাতে হলে প্রয়োজন হবে লাইসেন্সের। কিন্তু এসব নিয়মনীতি চরমোন্তাজের করাতকল মালিকেরা মানেন না। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই করাতকল আর ইটভাটার মালিকেরা প্রভাবশালী। তাদের সঙ্গে বন বিভাগের যোগসাজস রয়েছে। প্রতিটি করাতকল থেকে বন বিভাগ মাসে আট থেকে দশ হাজার টাকা মাসোহারা পায় বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।  

সরেজমিন ঘুরে বাংলানিউজ দেখতে পায়, সংরক্ষিত বনের এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে চরমোন্তাজের দাঁড়ভাঙ্গায় আবু মিয়া, চর মার্গারেটে কাশেম মোল্লা, নয়ারচরে আলবগীর মাল, মধ্যমোন্তাজে আল আমিন আকন ও জালাল শরীফ, উত্তর চরমোন্তাজে কাদের আকন, পশ্চিম চরমোন্তাজে জিয়া ফরাজী, চর মন্ডলে বাশার খন্দকার এবং নলুয়ায় জয়নাল প্যাদা লাইসেন্স ছাড়াই করাতকল স্থাপন করেছেন। এগুলোতে দিনরাত দেদারছে সংরক্ষিত বনের কাঠ চেরাই চলছে।
      
একইভাবে নদীপথে যাওয়ার সময় বাংলানিউজের চোখে পড়ে ভোলার চরফ্যাসনের চরমাইনকা নামক স্থানে ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। উড়ছে কালো ধোuয়া। অথচ ওই ইটভাটার বিপরীতেই রয়েছে চর ইসলাম সংরক্ষিত বন। সংরক্ষিত এলাকার আশপাশে আরও বেশ কয়েকটি এলাকায় ইটভাটা চোখে পড়ে।

অপর এক খবরে জানা গেছে, সংরক্ষিত বনাঞ্চল অধ্যুষিত পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় লাইসেন্স বিহীন অন্তত ৩০টি করাতকল রয়েছে। লাইসেন্সবিহীন এসব করাতকলে সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ উপকূলীয় বাঁধ বাগান, সামাজিক বনায়নের গাছ অহরহ চেরাই চলছে। ফলে উপকূলীয় বনাঞ্চল এখন চরম হুমকির মুখে রয়েছে। দশ বছরে এসব করাতকলের কারণে বেড়িবাঁধের বাইরের মাইলের পর মাইল বনাঞ্চল উজাড় হয়ে গেছে বলে স্থানীয় লোকজন জানান।

অভিযোগ রয়েছে, বনবিভাগের সংশ্লিষ্ট রেঞ্জের কর্মকর্তা, বিট কর্মকর্তা ও ফরেস্টগার্ডদের প্রত্যক্ষ যোগসাজশে বছরের পর বছর এসব করাতকল চালু রয়েছে। বনাঞ্চলসহ পরিবেশ রক্ষার্থে উপজেলা বন ও পরিবেশ কমিটি রয়েছে। কিন্তু এ কমিটির কার্যক্রম চলছে কাগজে কলমে। বহুবার সভা চলাকালে অবৈধ করাতকল বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হলেও কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

কলাপাড়ার লালুয়ার চর নিশানবাড়িয়া এলাকার নারী ইউপি সদস্য রাবেয়া বেগম জানান, শিশুগাছ, ছইলা, কেওড়া গাছ দেদার কেটে আশপাশের করাতকলে চেরাই করা হয়। তাদের বেড়িবাঁধের বন উজার করে দেয়া হয়েছে। এখন এ কারণে তাদের বেড়িবাঁধটি চরম ঝুকিপুর্ণ হয়ে আছে। দুর্যোগকালীন লাখো মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পরেছে।

একই দৃশ্য কলাপাড়া উপজেলার সব কটি ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের ঢালের। হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। রাতের আধাuরে কেটে সংলগ্ন করাতকলে চেরাই করে বিক্রি করা হয়। আবার এসব গাছ বিভিন্ন ইটভাটায় পাচার করা হয়।

তথ্যসূত্র বলছে, কলাপাড়ার লতাচাপলী ইউনিয়নের লক্ষ্মীর পোলের দুইদিকে দুটি করাতকল রয়েছে। অথচ এখান থেকে গঙ্গামতি ও ধুলাসার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দুরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার। এভাবেই কোন ধরনের নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করেই করাত কল নির্মিত হয়েছে। চলছে গাছ চেরাইয়ের কাজ। মোটকথা যে যার মতো যেখানে সেখানেই স্থাপন করেছে করাতকল।

ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, কলাপাড়ার চাকামইয়ায় একটি, টিয়াখালীতে একটি, লালুয়ায় চারটি, মিঠাগঞ্জে তিনটি, নীলগঞ্জে পাঁচটি, মহিপুরে পাঁচটি, লতাচাপলীতে পাঁচটি, ধানখালীতে সাতটি, বালিয়াতলীতে আটটি, ডালবুগঞ্জে দুইটি এবং চম্পাপুর ইউনিয়নে পাঁচটি করাত কল রয়েছে। এছাড়া কলাপাড়া পৌর শহরে রয়েছে ১৩টি করাতকল রয়েছে।

বনবিভাগ কলাপাড়ার তথ্যমতে কলাপাড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়নসহ পৌরসভায় মোট করাতকল রয়েছে ৫৯টি। যার দুই তৃতীয়াংশ অবৈধ। কলাপাড়ার বনকর্মকর্তা ইয়াকুব আলীর দাবি প্রায় ৪০টির লাইসেন্স আছে। তবে এর সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই।

লাইসেন্স বিহিন করাতকল আছে, এমন অভিযোগের কথা বাংলানিউজের কাছে স্বীকার করলেন বন বিভাগের চরমোন্তাজ রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. কামালুজ্জামান। তবে সেসব করাতকলে সংরক্ষিত বনের গাছ কাটা হয় না বলে দাবি করেছেন তিনি। একইসঙ্গে বনের গাছ কাটার সঙ্গে বন বিভাগের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগও অস্বীকার করেন এই রেঞ্জ কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ০১৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।