সন্দ্বীপ ঘুরে এসে: দ্বীপের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রশ্নটি তারা বার বারই করছিলেন- ‘ক্রসড্যামের দাবি কী চাপা পড়েই থাকবে? দ্বীপ রক্ষায়, এখানকার মানুষের জীবন বাঁচাতে আর সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতে ক্রসড্যামের দাবি উঠেছে। এক চরের সঙ্গে আরেক চরের বাঁধ দিয়ে পলি জমিয়ে জাগিয়ে তোলা যায় বিপুল পরিমাণ ভূমি, রক্ষা পেতে পারে ভাঙন থেকে, পুনর্বাসিত হতে পারেন হাজারো মানুষ।
সন্দ্বীপের হারামিয়া এলাকার বাসিন্দা নেয়ামত উল্লাহ বলছিলেন, সন্দ্বীপ-উড়িরচর ক্রসড্যাম বাস্তবায়িত হলে সন্দ্বীপের মানুষেরা উপকৃত হবেন। এ ড্যাম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন আমাদের লালিত স্বপ্ন পূরণের দিকে এগোতে পারি, তেমনি এলাকাটি অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। এর মাধ্যমে দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগ স্থাপিত হবে। এ সংযোগ বদলে দেবে মানুষের ভাগ্য।
নদীর বুকে জেগে ওঠা চর আবার ভেঙে যাওয়ার দৃশ্য আঙ্গুল তুলে দেখাতে দেখাতে গুপ্তছড়া গ্রামের বাসিন্দা মোতালেব হোসেন বলছিলেন, চর জাগে, আবার সে চর হারিয়ে যায়। আমরা তো যুগ যুগ ধরে এভাবে আছি। নতুন চর আমাদের স্বপ্ন জাগায়, সে স্বপ্ন আবার ভেঙে যায়। ক্রসড্যাম হলে নতুন চরের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে। পূরণ হবে এখানকার মানুষের স্বপ্ন।
সূত্র বলছে, গত ৬০ বছরে এখানকার ২৪টি ইউনিয়নের মধ্যে আটটিই হারিয়ে নদীতে বিলীন হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এখানকার মানুষদের মাঝে এখনও আতঙ্ক ছড়ায়। পনেরোটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত সন্দ্বীপ উপজেলায় সাড়ে তিন লাখ লোকের বসবাস। এ দ্বীপ থেকে জেলা সদর চট্টগ্রাম কিংবা অন্যান্য স্থানে যখন ইচ্ছা তখন যাওয়া যায় না। নৌ-পথই একমাত্র উপায়। নৌ-পথে চলাচল করতে যেমন হয়রানির শিকার হতে হয়, তেমনি পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ।
এ দুরাবস্থা থেকে সন্দ্বীপকে রক্ষা করতেই সন্দ্বীপ-উড়িরচর ক্রসড্যাম নির্মাণের দাবি ওঠে। এ ড্যাম নির্মাণ করা হলে সম্ভাবনাময় এ দ্বীপ শুধু ভাঙন থেকেই রক্ষা পাবে না, বিপুল পরিমাণ ভূমিও উদ্ধার হবে।
ভাঙন রোধ আর বিপুল পরিমাণ ভূমি উদ্ধারের লক্ষ্য সামনে রেখে প্রস্তাবিত ক্রসড্যাম নির্মাণের কাজ গত চার দশকেও শুরু হয়নি। কবে নাগাদ এ কাজ শুরু হবে কিংবা তা আদৌ হবে কি-না, এ নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র বলছে, এ ক্রসড্যাম নির্মাণের জন্য ৬৮৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ইতোপূর্বে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ দলের জরিপ চলছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের প্রচারকালে সন্দ্বীপ সফর করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সময়ই দ্বীপটি রক্ষায় ক্রসড্যাম নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। সেই থেকে ক্রসড্যামের আশায় বুক বাঁধছেন এখানকার মানুষ।
সূত্র বলছে, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার ও নেদারল্যান্ড সরকারের মধ্যে সন্দ্বীপ-নোয়াখালী ক্রসড্যাম নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার জন্য একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী নানা কার্যক্রম শেষে ১৯৮৬ সালে সন্দ্বীপ-উড়িরচর-নোয়াখালী ক্রসড্যাম প্রকল্প বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। ওই সময়ের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ৪২নং ক্রমিকে প্রকল্পটি তালিকাভূক্ত হয়। সে অনুযায়ী ১৯৮৮ সালে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়ে ১৯৯২ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলোর অনাগ্রহের কারণে এটি আর সফলতার মুখ দেখেনি।
চার দশক পর গত মহাজোট সরকারের উড়িরচর-চর ক্লার্ক ক্রসড্যাম নির্মাণে বরাদ্দ দেওয়ার খবরে নতুন করে আশা জাগে এখানকার মানুষের মনে। ২০১১ সালের শেষ দিকে সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রস্তাবিত ক্রসড্যাম এলাকা পরিদর্শনে যান। এরপর বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত প্রকল্প হিসেবে সরকার এটি বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় ৬৮৩ কোটি টাকা ডিপিপি চূড়ান্ত করে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের বরাদ্দ চেয়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এখানেই চাপা পড়ে প্রকল্পের কাজ।
২০১২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সন্দ্বীপ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি হাজি এ বি কলেজ সংলগ্ন মাঠে দ্বীপের ক্ষতি না হলে ক্রসড্যাম বাস্তবায়ন করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এলাকাবাসী এখনও সেই প্রতিশ্রুতির দিকেই তাকিয়ে আছেন। দিন গুণছেন কবে হবে স্বপ্নের ক্রসড্যাম।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র বলছে, দক্ষিণের সমুদ্রতীরের ভূমি উদ্ধার, সন্দ্বীপের ভাঙন রোধ এবং দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে দ্বীপটিকে যুক্ত করতে ১৯৬৬ সালে সরকার কোম্পানীগঞ্জ থেকে উড়িরচর হয়ে সন্দ্বীপ পর্যন্ত ক্রসড্যাম প্রকল্প গ্রহন করে। প্রকল্পটি সন্দ্বীপ-নোয়াখালী-উড়িরচর ক্রসড্যাম প্রকল্প নামে পরিচিতি পায়। ওই সময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫০২ কোটি টাকা। তবে তখন উড়িরচর অনেক ছোট ছিল। দিনে দিনে পলি জমে জমে উড়িরচর বিশাল চরে পরিণত হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জের সঙ্গে সন্দ্বীপের দূরত্বও কমে গেছে। এর ফলে প্রকল্প ব্যয় অনেক কমে যাবে।
এদিকে বিভিন্ন সময় ক্রসড্যাম নিয়ে পরিচালিত সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, এ ক্রসড্যাম নির্মিত হলে নোয়খালী জেলার চর ক্লার্ক, চর এলাহী ও কোম্পানীগঞ্জ এবং চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ-উড়িরচর একত্রিত হবে। ফলে চট্টগ্রাম জেলার উত্তর-পশ্চিম ও নোয়াখালী জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকা পরস্পরের মধ্যে সংযুক্ত হওয়ায় স্থলপথের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দ্বার খুলে যাবে।
সমীক্ষা বলছে, সেই সঙ্গে ক্রসড্যাম নির্মাণের ফলে অদূর ভবিষ্যতে নদীর বুকে ভেঙে যাওয়া প্রায় ১ লাখ একর জমি আবার চর হিসেবে জেগে উঠবে। এ এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও দেখা দেবে।
এদিকে সম্পূর্ণ প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল দ্বীপ সন্দ্বীপ মেঘনার ছোবলে হারিয়ে যেতে বসেছে। উপজেলার আমিরাবাদ, বাটাজোড়া, ইজ্জতপুর, দীর্ঘাপাড়, রুহিনী, ন্যায়ামস্তি ইউনিয়নের শুধু নামই আছে। মানচিত্র থেকে হারিয়েছে অনেক আগেই। মোগল স্থাপত্যের স্মৃতিবিজড়িত চারিআনি বাজারে নির্মিত সাহেবানী মসজিদসহ পুরনো সন্দ্বীপ টাউনের বহু সরকারি-বেসরকারি ভবন এখন শুধু এলাকাবাসীর স্মৃতিতে ভাসে, বাস্তবে নেই।
ক্রমাগত ভাঙনের এ চিত্র আর এখানকার মানুষ দেখতে চান না। তারা আর নি:স্ব হতে চান না। ঐতিহ্যবাহী সন্দ্বীপকে আর ছোট হতে দিতে চান না। তাইতো ক্রসড্যামের দাবিটাকে তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার দাবি হিসাবে দেখছেন।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, জুন ০৭, ২০১৪