ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

সাউথখালীতে এখনও দুর্যোগের ভয়!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৫ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৪
সাউথখালীতে এখনও দুর্যোগের ভয়! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সাউথখালী, শরণখোলা, বাগেরহাট থেকে: বলেশ্বর নদী আর সুন্দরবনের গা ঘেঁসে জেগে থাকা সাউথখালীর মানুষের ভয় কাটেনি এখনও। বার বার দুর্যোগের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হওয়া জীবন ভয়কে জয় করার চেষ্টা করে যাচ্ছে জীবনব্যাপী।

সমুদ্র মোহনায় এই জনপদ ২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। আইলা, মহাসেনের মত ঝড়ের তাণ্ডব এই এলাকার মানুষ মোকাবেলা করেছে। তারপরও এই এলাকার মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

শরণখোলার উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজার থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে বলেশ্বর তীরের গ্রাম সাউথখালী সরেজমিন ঘুরে সেখানকার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া গেছে দুর্যোগ ঝুঁকির নানান তথ্য। বর্ষায় এই ঝড়ের মৌসুমে নদীতীরের মানুষগুলো প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সিডরে ক্ষতির পর যে সহায়তা পাওয়া গিয়েছিল, তা জীবনে গতি ফেরাতে পারেনি। নি:স্ব মানুষদের অনেকেই কোনমতে বসবাস করছে বাঁধের ধারে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, যেখানে সিডর বড় ধাক্কাটা দিয়েছিল, কিংবা অন্যান্য দুর্যোগে যে জায়গাটি দিয়ে পানি উপচে লোকালয়ে ঢুকে পড়তো, সেই জায়গাটি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। জোয়ারের পানি বাঁধ ছুঁই ছুঁই করছে। স্থানীয়রা জানালেন, এই বাঁধ কোথাও ছয় ফুট, কোথাও আট ফুট আবার কোথাও দশ ফুট। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অন্তত কুড়ি ফুট উঁচু বাঁধের দাবি এলাকাবাসীর। প্রতিটি ঝড়ের পর একই দাবি উঠলেও সে দাবি কাগজেই থেকে যায়।

সূত্র বলছে, শরণখোলার পার্শ্ববর্তী মোরেলগঞ্জ উপজেলার খাওয়ালিয়া ইউনিয়নের সন্যাসী থেকে শুরু করে শরণখোলার বগী হয়ে শরণখোলা ঘুরে পুনরায় মোরেলগঞ্জ উপজেলা সদর পর্যন্ত বাঁধের অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ। এই বাঁধ কোন বড় ধরনের দুর্যোগ ঠেকাতে পারবে না বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। সাউথখালী ইউনিয়নের সোনাতলা এলাকায় বাঁধের উচ্চতা আট ফুট আর সাউথখালী এলাকায় এই উচ্চতা ছয় ফুটের বেশি নয় বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

রায়েন্দা ইউনিয়নের তাফালবাড়ি বাজারের ছোট্ট চায়ের দোকানে কথা হচ্ছিল ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাহজাহান বাদল জোমাদ্দার, স্থানীয় বাসিন্দা জামাল হোসেন জোমাদ্দার, মিন্টু মিয়াসহ আরও অনেকের সঙ্গে। সিডরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তারা জানান, ওই দুর্যোগে অন্তত ১৫ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস এসেছিল। কিন্তু বাঁধ আছে মাত্র ১০ ফুট উঁচু। সিডরের পর বাঁধের বিভিন্ন এলাকায় কাজ হলেও তাতে উচ্চতা সর্বোচ্চ তিন ফুট বাড়তে পারে।

রায়েন্দা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাহজাহান বাদল জোমাদ্দার বাংলানিউজকে বলেন, দুর্যোগের পরে অনেক প্রকল্প নেওয়া হলেও ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না। উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে এলাকার মানুষের মতামত নেওয়া হয় না। আবার কখনো এলাকার মানুষ মতামত দিলেও তা গ্রহণ করা হয় না।

সাউথখালী ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রের উদ্যোক্তা মো. জাকারিয়া বলেন, এলাকার মানুষ এখনও সারাক্ষণ ভয়ে থাকে। আকাশে মেঘ দেখলে মানুষ ছোটে আশ্রয়ের সন্ধানে। বর্ষায় নদী উত্তাল হয়, জোয়ারের পানি বাড়ে। বাঁধের তীরে ও বাঁধের বাইরে থাকা মানুষ তখন সংকটে দিন কাটায়।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার দাবি জানান তিনি।


স্থানীয়রা জানালেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বেশ কয়েকদিন ধরে এই এলাকায় ভারী বর্ষণে খালবিল আর ফসলি মাঠ পানিতে ডুবে আছে। নিচু এলাকার বাড়িঘরেও ঢুকেছে পানি। তাফালবাড়ি লঞ্চঘাটে বাঁধের পাশে বাড়িঘর ঘুরে চোখে পড়লো মানুষের চরম দুর্দশার চিত্র। এই অবস্থায় তিনবেলা ভাত জোটানোও যেন তাদের পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শরণখোলার প্রাণকেন্দ্র দক্ষিণের ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যকেন্দ্র রায়েন্দা বাজারটি রয়েছে বাঁধের বাইরে। এখানে নিরুত্তাপহীন আরও বেশকিছু বাড়িঘর ও সরকারি স্থাপনা। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় গোটা বাজার। নিরাপত্তার জন্য মাত্র আড়াই কিলোমিটার বাঁধের দাবি এলাকাবাসীর।

এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সাউথখালী ও তাফালবাড়িয়ার নদী তীরবর্তী এলাকায় বনের দেয়ালও নেই। সিডরে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া এই এলাকার বড় হওয়া গাছগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়েছিল। ছয়-সাড়ে বছর বয়সী গাছের চারাগুলো কেবল মাথা তুলেছে। এই গাছপালা বড় হতে সময় লাগবে আরও কয়েক বছর। বছরে বছরের দুর্যোগের ঝাপটা কাটিয়ে কবে নাগাদ এই গাছগুলো আবার নিরাপত্তা দেবে, তা কারও জানা নেই।   

শরণখোলার সাউথখালী, তাফালবাড়ি, রায়েন্দা যেখানেই জড়ো হওয়ার মানুষদের সঙ্গে আলাপ হলো, সবাই সিডরের তাণ্ডবে উদাহরণটাই সামনে নিয়ে আসেন। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর রাতের দৃশ্য তাদের স্মৃতিতে এখন জ্বল জ্বল করছে। কথা বলতে গিয়ে স্বজন হারানো মানুষের সেই হৃদয়বিদার ঘটনার দৃষ্টান্ত টানেন। তারা আর সেই বিভীষিকাময় দৃশ্যের মুখোমুখি হতে চান না। আর সে কারণেই নিরাপত্তার দাবিটাই তাদের কাছে প্রধান।        

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৪ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।