শরণখোলা, বাগেরহাট ঘুরে এসে: সুন্দরবনের বনজীবীরা এখন বিকল্প কাজ চান। দস্যু আতঙ্ক, বাঘের ভয়, সাপের ছোবল আর কুমিরের আক্রমণের মুখে তারা আর বনে যেতে চান না।
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন সংরক্ষণে বনে সব ধরনের পাস-পারমিট বন্ধে সরকারি আদেশ আসছে মর্মে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে গত কয়েক দিন ধরে। এ গুজবকে কেন্দ্র করে বনজীবীদের বিকল্প কাজের দাবি আরও জোরালো হয়েছে। বনের ভেতরে জীবিকা খুঁজে ফেরা এই মানুষগুলো এমন কিছু কাজ চান, যাতে সুন্দরবনে আর যেতে না হয়।
সরেজমিনে ঘুরে সুন্দরবন লাগোয়া শরণখোলা, মোরেলগঞ্জের বহু বনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছে বাংলানিউজ।
শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবন ঘেঁষা সীমানায় ভোলা নদীর তীরে শরণখোলা বাজার। এ এলাকার অন্তত ৯০ শতাংশ মানুষ বনের ওপর নির্ভরশীল। বনে মাছ ধরা থেকে শুরু করে মধু আহরণ, কাঁকড়া ধরা, চিংড়ির পোনা ধরা, গোলপাতা কাটাসহ বিভিন্ন কাজে বনজীবীরা জীবিকার পথ খোঁজেন।
শুধু শরণখোলা গ্রাম কিংবা বাজারের লোকজন নয়, তেরাবেকা, বগী, গাবতলা, সাউথখালী, রায়েন্দাসহ গোটা শরণখোলা উপজেলার বহু মানুষের জীবিকার উৎস এই সুন্দরবন। ছোটবেলা থেকে বাবা-দাদার সঙ্গে থেকে বনের বিভিন্ন কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠে তারা। লেখাপড়া শেখার জন্য বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোনোর চেয়েও যেন বনে গিয়ে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করাটা এইসব এলাকার শিশুদের জন্য খুব জরুরি।
বনজীবীরা জানালেন, বছরের সব মৌসুমে একই ধরনের কাজ না থাকলেও মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তারা। তবে অধিকাংশ সময়ই কাজ থাকে না বলে জানান তারা। বনের মৎস্যজীবীরা বলেন, বনের মাছ কমে গেছে, মধু আহরণকারীরা বলেন, আগের মতো মধু পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যান্য সম্পদ আহরণকারীরাও একই কথা বলেন। এসব কারণে বনে যেতে তাদের আগ্রহ দিন দিন কমছে।
শরণখোলা বাজারে সুন্দরবন ঘিরে জীবিকার খোঁজ নেওয়ার সময় বহু বনজীবীর ভিড় জমে যায়। জালাল মোল্লা, আব্বাস কবিরাজ, আবদুস সোবাহান, আবদুল আলী হাওলাদার, শহিদ খলিফা, মনসুর মৃধা, ইউনুস জোমাদ্দার, সাইফুল ইসলামসহ আরও অনেকে উপস্থিত হন সেখানে। সবাই যেন কিছু একটা বলতে চান। অনেকেই বললেন, বহুমূখী বিপত্তি পেরিয়ে বনে গিয়েও তাদের সারা বছর সংসার চালিয়ে নেওয়ার মতো অবস্থা হচ্ছে না।
সাইফুল ইসলাম। বয়সে একেবারেই তরুণ। ২০ বছরও পেরোয়নি। এক মাস চারদিনের মধু আহরণ মিশন শেষে মাত্র কয়েক দিন আগে বাড়ি ফিরেছেন। দশ জনের দলের পাস-পারমিট ছিল দু’মাসের। তারা প্রত্যেকে মাথাপিছু প্রায় তিন মণ করে মধু পেয়েছেন। হয়তো ছ’মাসে আর তেমন কোনো কাজ থাকবে না। অন্যদিকে মধু আহরণকালে বনের ভেতরে যেসব ঝুঁকিতে পড়তে হয়েছে, তা এই আহরিত মধুর দামের তূলনায় কম।
মনসুর মৃধা। বয়স ৬০ বছর পেরিয়েছে। এখনও জীবিকার জন্য ছোটেন সুন্দরবনে। ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে থেকে এই কাজে। আরও কতোদিন করতে হবে জানেন না। সাতদিনের পাস-পারমিট নিয়ে নৌকায় মাছ ধরতে যান বনে। নৌকায় থাকেন তিনজন লোক। এ সময়ে ৫-৬ হাজার টাকার মাছ পাওয়া যায়। ভাই হাবিব মৃধাকে বাঘে নিয়েছে। নিজেও বাঘের সামনে পড়েছেন একাধিকবার। বিকল্প কাজ নেই বলে এটাই করতে হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে সুন্দরবনের সম্পদ আহরণে বহুমূখী প্রভাব পড়েছে বলে বনজীবীদের দাবি। তারা জানান, আগে একবার বনে গেলে যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যেতো, এখন সারা বছরেও তা মেলে না। অন্যান্য সম্পদও কমে গেছে। আলাপ প্রসঙ্গে বনজীবীরা সবচেয়ে জোর দেন সুন্দরবনের খালে বিষ ঢেলে মাছ মারার ওপরে। তারা জানান, একটি অসাধু মহল নদীতে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরছে। এর ফলে মাছ কমে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। এ বিষয়ে বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মহলের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
বনজীবীরা বলেন, বনের সম্পদ আহরণে নানামূখী প্রতিবন্ধকতায় বনজীবীরা মালিকের কাছে বিপুল পরিমাণ দেনা হচ্ছেন। দেনার পরিমাণ ৭০-৮০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দেনার ভার বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা।
শরণখোলা বাজারের বিপরীতে সুন্দরবনের ভেতরে বন বিভাগের অফিস। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের আওতায় এখানে রয়েছে শরণখোলা স্টেশন ও শরণখোলা রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়। ভোলা নদী পার হয়ে সেখানে যেতে সময় লাগে মাত্র পাঁচ মিনিট।
রেঞ্জ কর্মকর্তা নেই। আলাপ হয় ফরেস্ট রেঞ্জার গোলাম রব্বানীর সঙ্গে। তিনি বলেন, সুন্দরবনের আশপাশের এলাকায় অভাবি মানুষদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন এই বন। বনে পারমিট নিয়ে মাছ, মধুসহ বিভিন্ন সম্পদ আহরণের সুযোগ তাদের আছে। তবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বনে আসা বনজীবীদের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ- উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ১০০৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৪