সোনাদিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার থেকে: যে দ্বীপ এক সময় ছিল পাখির রাজ্য। যেখানে সবুজ বনানী আর নীল জলের মিলনমেলায় প্রকৃতি পেতো ভিন্ন রূপ।
দু’দিন দ্বীপটিতে অবস্থান করে একটি পাখির দেখাও মিলল না। ডিম ছাড়তে সমুদ্র থেকে আসা কচ্ছপের সংখ্যাও আগের চেয়ে অনেক কমেছে। লাল কাঁকড়ার তো দেখাই মেলে না। সোনা ফলানো দ্বীপের শত শত একর জমি পতিত পড়ে থাকছে। বন কেটে ফেলে করা হয়েছে চিংড়ি ঘের।
তবুও দীর্ঘ সৈকতের অপার সৌন্দর্য নিয়ে সমুদ্রতীরে জেগে থাকে দ্বীপ। সূর্য ডুবছে প্রকৃতির নিয়মে। ভোরের আলো ফুটে পূব আকাশে উদিত হচ্ছে নতুন সূর্য। অবারিত সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয় নতুন এক একটি দিনের।
সমুদ্র তীরের জেলা কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া দ্বীপের অবস্থা এমনই। এখানে আছে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আছে অপার সম্ভাবনা। এতো সম্ভাবনা থাকার পরেও এখানকার মানুষের সঙ্কটের শেষ নেই। সরকারের উর্ধ্বতন মহলের নজরদারি অভাবে সব সম্ভাবনা হারাতে বসেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এ এলাকার উন্নয়নে ও সম্ভাবনা বিকাশে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন।
দেশ-বিদেশে নাম ছড়ানো দ্বীপ সোনাদিয়া কীভাবে বদলে যাচ্ছে-এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলানিউজের কাছে স্থানীয় বাসিন্দাদের নানা অভিযোগ। আগের সোনাদিয়ার সঙ্গে এখনকার সোনাদিয়ার তুলনা করতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তিরা বললেন, এ সংরক্ষিত বনে বিপুল পরিমাণ বন ছিল। বনে বসতো হাজারো পাখি। শীতে অতিথি পাখির দেখা মিলতো প্রচুর পরিমাণে। সেই বন উজাড় হয়ে এখন চিংড়ি ঘেরে পরিণত হয়েছে। এতে আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হওয়া সম্ভব হলেও পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে।
সোনাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শচিরাম দাস বলেন, এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ হওয়ায় পর্যটকদের আসা-যাওয়ায় সমস্যার অন্ত নেই। মহেশখালী উপজেলা সদর গোরকঘাটা থেকে ঘটিভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার পথ কোনোভাবে আসা সম্ভব হলেও এর পরের অংশে চার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সোনাদিয়া পর্যন্ত পৌঁছানোটা সবার পক্ষেই দু:সাধ্য। এইটুকু পথে তিনটি নদী। দু’টিতে বড় পাকা ব্রিজ থাকলেও রাস্তার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। একটি নদীতে আছে নড়বড়ে সাঁকো।
দ্বীপের বর্গাচাষি মোবারক হোসেন বলেন, এখানে সম্ভাবনার শেষ নেই। এখানকার জমি সব ধরনের ফসলের জন্য উপযোগী। অথচ উদ্যোগের অভাবে দ্বীপে বহু জমি পতিত পড়ে থাকছে। এই উর্বর জমিতে কৃষি প্রকল্প নিয়ে সরকার লাভবান হতে পারে, সেইসঙ্গে লাভবান হবেন চাষিরা।
দ্বীপের বিভিন্ন এলাকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, এক সময় এখানকার সমুদ্র সৈকতে ঝিনুক, লাল কাঁকড়া, কচ্ছপ ছিল প্রচূর পরিমাণে। এখন সেগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে। দ্বীপের বাসিন্দারা সেসব এখন আর তেমনটা দেখতে পান না। কচ্ছপের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে সমুদ্রে অবমুক্ত দেওয়ার লক্ষ্যে দ্বীপের সৈকতে কয়েকটি হ্যাচারি স্থাপিত হলেও সৈকতে কচ্ছপ পাওয়া যাচ্ছে খুবই কম। ডিসেম্বরে দু’টি কচ্ছপ থেকে মাত্র ২৪৬টি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানালেন দ্বীপের পূর্বপাড়ায় হ্যাচারির দায়িত্বে থাকা আলী আহমেদ।
সমুদ্র আর নদী ঘেরা জনপদ মহেশখালী উপজেলা সদর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে কুতুবজোম ইউনিয়নের আওতাভূক্ত দ্বীপ সোনাদিয়া। গোটা দ্বীপটি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আওতায়। সোনাদিয়ার মোট জমির পরিমাণ ২৯৬৫ দশমিক ৩৫ একর। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির পরিমান ৩ দশমিক ১৫ একর। শুঁটকি মহাল ২টি, চিংড়ি চাষযোগ্য জমির পরিমান ৯৮ দশমিক ০০ একর। বন বিভাগের জমির পরিমাণ ২১০০ একর। বাকি সব প্রাকৃতিক বনায়ন ও বালুময় চরাঞ্চল।
দ্বীপের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি বলে দাবি চরের অনেকেরই। আগে এখানকার সমস্যার সমাধান করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলেই সম্ভাবনাগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। অনেক চেষ্টা করেও দ্বীপের উন্নয়ন সেভাবে এগিয়ে নিতে পারছেন না বলে বলে জানালেন সোনাদিয়ার ওয়ার্ড মেম্বার আবদুল গফুর (নাগু মেম্বার)। তার দাবি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটলে দ্বীপবাসীর জীবনধারায় পরিবর্তন আসবে। শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বাড়বে। তখন দ্বীপের মানুষেরা নিজেরাই দ্বীপ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবে।
সূত্র বলছে, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সমৃদ্ধ সোনাদিয়ায় রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত প্যারাবন, দূষণ ও কোলাহলমুক্ত সৈকত। এখানে লাল কাঁকড়া, কচ্ছপের শেষ চিহ্ন এখনও দেখার সুযোগ আছে। দ্বীপের পূর্বদিকে নতুন জেগে ওঠা চরে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ রয়েছে। দ্বীপবাসীর নিজস্ব সংস্কৃতি ও সাদাসিধে জীবন যাপন, হযরত মারহা আউলিয়ার মাজার ও তার আদি ইতিহাস, জেলেদের সাগরের মাছ ধরার দৃশ্য, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য, প্যারাবন বেষ্টিত আকাঁ-বাঁকা নদীপথে নৌকা ভ্রমণ পর্যটকদের ভ্রমণের পিপাসা মেটাবে নি:সন্দেহে।
সোনাদিয়া দ্বীপের অধিকাংশ মানুষের পেশা সমুদ্রে মাছধরা। কিছু পরিবার চিংড়ি ও লবণ উৎপাদনে জড়িত। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অত্যন্ত পরিশ্রমী। পুরুষেরা সমুদ্রে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরেন আর নারীরা সে মাছ বাজারজাতকরণের কাজে সক্রিয় অংশ নেন। মাছ শুকানো ও গুদামজাত প্রক্রিয়া তো বলতে গেলে নারী ও শিশুরাই করে থাকে। এমনিতেই দেশব্যাপী সোনাদিয়ার সামুদ্রিক মাছের কদর খুব বেশি। বিশেষ করে শীত মৌসুমে তৈরি হয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের শুঁটকি। কক্সবাজারে পর্যটনে আসা বহু পর্যটক সোনাদিয়ার শুঁটকির লোভ সামলাতে পারেন না।
সোনাদিয়ার দ্বীপের নামকরণের সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে জনশ্রুতি আছে, এককালে চট্টগ্রামের বাশঁখালী থেকে কিছু জেলে অস্থায়ীভাবে সোনাদিয়ার মাছ শিকারে আসতেন। একজন জেলে সমুদ্রে জাল ফেলার পর জালে শিলাখণ্ড দেখতে পান। এটি তার কাছে খুবই আর্কষণীয় এবং মূল্যবান মনে হয়। শিলাখণ্ডটি জেলে তা নিয়ে ঘরের দরজা সামনে পা ধোয়ার সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার শুরু করেন। কিছুদিন পর জেলেটি পাথরের শিলাখণ্ডটি দায়ের শান দিতে গেলে বুঝতে পারেন, আসলে সেটি একটি স্বর্ণখণ্ড। এ ঘটনার কারণে দ্বীপের নাম ‘সোনাদিয়া’ হয়েছে বলেও শতবর্ষীদের মুখে শোনা যায়।
যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্বেও এ দ্বীপে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে যথাযথ উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নেই। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা হলে বিশ্বব্যাপী পর্যটনকেন্দ্রের রাজধানী হিসাবে পরিচিত কক্সবাজারের অন্যতম আকর্ষণ হতে পারে সোনাদিয়া। কারণ, কক্সবাজার সৈকত থেকে অতি সহজেই যাওয়ার সুযোগ রয়েছে সোনাদিয়া দ্বীপে। এ উদ্যোগ কক্সবাজারের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি দ্বীপবাসীর জন্য বিকল্প আয়ের ক্ষেত্র সৃষ্টি করবে।
সোনাদিয়া দ্বীপ বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত পরিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা। দ্বীপে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে ইকোট্যুরিজমের উন্নয়ন ঘটাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। দ্বীপবাসীর সম্পৃক্ততায় কমিউনিটিভিত্তিক ইকোট্যুরিজমের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যা দ্বীপবাসীর বিকল্প আয়ের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরা-খবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৪