কলাপাড়া, পটুয়াখালী : বর্ষার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সমুদ্রের লবণ পানি চাষিদের সর্বনাশ ডেকে আনছে। ভেসে যাচ্ছে আউশের ক্ষেত।
সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কয়েক হাজার চাষি এবার এই সংকটে পড়েছেন। লবণ পানির প্রভাবসহ বহুমুখী প্রাকৃতিক দুর্যোগে বার বার ফসলহানির ফলে এই অঞ্চলের চাষিরা অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন। অনেকে নিজের জমি থেকে উৎপাদনের আশা ছেড়ে দিয়ে বিকল্প আয়ের দিকে ঝুঁকছেন।
সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, এবার এপ্রিলে পূর্ণিমা পরবর্তী প্রথম জোয়ারের পানির প্রবল চাপে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ এলাকা দিয়ে লোনা পানি প্রবেশ করে কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকায়। এর ফলে ইউনিয়নের পাঁচ গ্রামের চাষিদের বোনা আউশ আবাদ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। এটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কিন্তু স্লুইসগেটগুলো প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় চাষিরা আরেকদফা ক্ষতির মুখোমুখি।
চাষিরা বলেছেন, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে স্লুইচগেট খুলে অভ্যন্তরীণ খাল-বিলে লোনা পানি প্রবেশ করানো হয়েছে। ফলে কৃষকের অন্তত এক হাজার একর জমির ফসল হানির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বহু বিল পুকুর তলিয়ে গৃহস্থালি কাজসহ গবাদিপশুর খাবার পানির তীব্র সঙ্কট শুরু হয়েছে। লালুয়ার চারিপাড়া, পশুরবুনিয়া, চৌধুরিপাড়া, নয়াকাটা, মহিপুরের নিজামপুর, চাকামইয়ার কাঠালপাড়ায় কৃষক সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কবলে পড়েছেন। বাড়ির উঠোনের সবজি পর্যন্ত লোনা পানিতে ডুবতে বসেছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত না করায় পর পর দু’টি বছর লালুয়ার রামনাবাদ নদী পাড়ের প্রায় দেড় হাজার কৃষক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। গত মৌসুমে আমন পায়নি এলাকার চাষিরা। এবার তারা শুকনো মৌসুমে বোনা আউশ আবাদের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু মৌসুমের প্রথম পুর্ণিমা পরবর্তী জোয়ারেই সব ফসল তলিয়ে গেছে।
এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি প্রভাবশালী মহল আবার স্লুইচ গেট খুলে অভ্যন্তরীণ খাল-বিল লোনা পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছে। রক্ষা পায়নি পুকুর পর্যন্ত। নিরাপদ পানির ভান্ডার নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এমন দৃশ্য দেখা গেছে চাকামইয়ার কাঠাল পাড়ায়। ছয় ভেন্টের স্লুইচ গেট খুলে অনবরত ভেতরে ঢোকানো হচ্ছে লোনা পানি। একই দৃশ্য নীলগঞ্জের নিজকাটা, টুঙ্গিবাড়িয়া, নীলগঞ্জ, হাজিপুর, সদরপুর, মেলাপাড়া, পক্ষিয়াপাড়া, তুলাতলী, ধানখালী, মহিপুরসহ সব কয়টি ইউনিয়নে।
উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৫০টি স্লুইচগেট খুলে লোনা পানির প্রবেশ করানো হয়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে প্রকৃতি এবং মানবসৃষ্ট বিপদ সাধারণ কৃষকের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। গোসলসহ রান্নার পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শুধু ফসল হানি নয়, বিভিন্ন ধরনের পানি বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটার শঙ্কা করছেন গ্রামের মানুষ।
ইউপি চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামার তারা জানান, চারিপাড়া ও পশুরবুনিয়া গ্রামের চারটি পয়েন্ট দিয়ে গত বছর বর্ষা মৌসুমে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। পানিউন্নয়ন বোর্ড বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিলে কৃষকরা আউশ আবাদ করে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সক্ষম হতো। এখন কৃষকদের জমি থাকলেও ফসল ফলানোর কোন সুযোগ নেই।
কলাপাড়ার লতাচাপলী ইউনিয়নের তুলাতলী এলাকার পাউবো বেড়িবাঁধের স্লুইচগেটে আগে থেকেই শাটার খুলে রাখা হয়েছে। প্রভাবশালীরা মাছ ধরার লোভে ফসলি মাঠে লবন পানি ওঠাচ্ছেন বলে চাষিরা জানিয়েছেন। তুলাতলী, নতুনপাড়া, মিশ্রিপাড়া, আছালতখাপাড়া, পৌরগোজা, বড়হরপাড়া, ডংকুপাড়া, মুসুল্লীয়াবাদ এই ৮ গ্রামের কয়েক হাজার একর ফসলি জমির রবি শস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
তুলাতলী গ্রামের চাষি নূরুল ইসলাম শেখ বলেন, আমি অনেক কষ্ট করে এক একর জমিতে উচ্ছে, করলা, পুঁইশাক, হলুদ, মরিচ চাষ করেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ লবন পানি ওঠানোর ফলে আমার জমির লক্ষাধিক টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। মিষ্টি পানির অভাবে সবজি ক্ষেত বিবর্ণ হয়ে গেছে।
আছালতপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল হালিম জানান, তার বাড়ির পিছনের খালে মিষ্টি পানি ছিল। ওই পানি দিয়ে সবজি ও বোরো চাষ করেছেন। খালের পানি লবনাক্ত হওয়ায় তিনি বিপাকে পড়েছেন।
কৃষি কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, লালুয়ার পাঁচটি গ্রামের প্রায় অন্তত ১০০ হেক্টর জমিতে আউশ চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে গ্রামের ভিতর লোনা পানি প্রবেশ করায় গ্রামের সকল জমি আউশ আবদ করার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে। উপজেলার আরও কয়েকটি এলাকায় একই অবস্থা।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ০৪৪৮ ঘণ্টা, মে ৩৯, ২০১৫
আরআইএম