১৯৮৮ সালের ৩০ নভেম্বর, বাবা গ্রেগরি এবং মাতা ভার্জিনিয়ার ঘরে নিউ সাউথ ওয়েলসের উত্তর উপকূলের একটি ছোট্র শহর ম্যাকসভিলে জন্মগ্রহণ করেন হিউজ। বাবা ছিলেন কলা চাষী আর ইতালিয়ান মা ঘরেই থাকতেন।
৬৩ রানে তখন অপরাজিত হিউজ, বোলিং মার্কে নিউ সাউথ ওয়েলসের পেসার শিন অ্যাবোট। তার একটি বাউন্স বলে পুল করতে গিয়েছিলেন হিউজ। টাইমিং না মেলায় বল গিয়ে লাগে হিউজের হেলমেটের নিচ দিয়ে কানের ঠিক নিচে, কাঁধের একপাশে। শেষ মুহূর্তে বলের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে এক করুণ সমাপ্তির চির-বেদনার গল্প হয়ে যান হিউজ। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে জ্ঞান হারান, যে জ্ঞান আর কখনোই ফিরে আসেনি। মাটিতে পড়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসায় অবস্থার পরিবর্তন না হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঘটনার পর পরই ম্যাচটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
হাসপাতালের বিছানায় কোমায় থেকেই তার মৃত্যু হয়। মেডিকেলের ভাষায় জানানো হয়, বলটি হিউজের মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ করা ধমনীতে আঘাত করলে সেই ধমনী ছিন্ন হয়ে যায় (vertebral artery dissection)। এরফলে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে ব্রেইন হ্যামারেজে মৃত্যু হয় তার। হিউজের এই চলে যাওয়া আর জীবন-মৃত্যুর মাঝের দুদিন বিশ্বক্রিকেটে ফ্যানদের এক সূঁতোয় গেথে দিয়েছিল, সোশ্যাল মিডিয়া আর আধুনিক প্রযুক্তি সবাইকে এক বিন্দুতে মিলিয়েছিল। এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা ক্রিকেটে আর যে ঘটেনি। অ্যারন ফিঞ্চ, ম্যাথু ওয়েড, ডেভিড ওয়ার্নার, স্টিভ স্মিথ, শেন ওয়াটসন, ব্রাড হাডিন, নাথান লায়ন, মরিস হেনরিকস, মিচেল স্টার্ক, ড্যানিয়েল স্মিথ থেকে শুরু করে সাইমন ক্যাটিচ, ব্রেট লি, ফিল জ্যাকস, পিটার ফরেস্ট, জর্জ বেইলি, জাস্টিন ল্যাঙ্গার, তখনকার অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের প্রধান নির্বাহী জেমস সাদারল্যান্ড, কোচ ড্যারেন লেহম্যান, ম্যানেজার প্যাট হাওয়ার্ড সবাই হাসপাতালে হিউজের পাশে ছিলেন। মেলবোর্ন থেকে ছুটে এসেছিলেন রিকি পন্টিং ও পিটার সিডল।
নিজ ঘরের বিপক্ষে খেলছেন বলেই হয়তো ক্রিকেটের স্বাভাবিক স্লেজিংটা নিয়মিতই হচ্ছিলো। প্রতিপক্ষের এক বোলার মজা করেই বলেছিলেন, "I will Kill You"! সেদিন মোট ২০টি বাউন্সার দেয়া হয়েছিল বাউন্সে কিছুটা দুর্বল হিউজকে। তবে, ১৯টি বাউন্স সাবলীলভাবেই রুখে দিয়েছিলেন হিউজ। কিন্তু ২০তম বাউন্সারটাই যে ক্যারিয়ারের শেষ বাউন্সার সেটা মাঠে উপস্থিত কেউই হয়তো কল্পনাতেও আনেননি। হিউজের মৃত্যুতে ভেঙে পড়ে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সে সময় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান বনাম নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার তৃতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিনের খেলা স্থগিত করা হয়। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া একাদশ ও ভারতীয় দলের অনুশীলন ম্যাচটিও বাতিল করা হয়। বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের মধ্যকার চতুর্থ ওয়ানডে শুরুর আগে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়েছিল এবং সকল খেলোয়াড় কালো ব্যাজ ধারণ করেছিলেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে ২০০৯ সালে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ার আগে নিউ সাউথ ওয়েলসের বিপক্ষে দুই মৌসুমের জন্য খেলেছিলেন বাঁহাতি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিউজ। শর্ট বল খেলার দুর্বলতার কারণে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ২০০৯ সালের অ্যাশেজ সিরিজ চলাকালীন সময়ে টেস্ট স্কোয়াড থেকে বাদ পড়ে যান। তার জায়গায় দলে আসেন শেন ওয়াটসন। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে এবং ২০১০ সালের মার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত করা হয় হিউজকে। হিউজকে দেখা হতো অস্ট্রেলিয়ার ‘দ্বিতীয় গিলক্রিস্ট’, অজি এই কিংবদন্তি উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের মতো না হলেও দলের প্রয়োজনে উইকেটের পেছনে দাঁড়াতেন হিউজ। অপার সম্ভাবনা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট অঙ্গনে আসলেও সম্ভাবনার রঙিন মলাটে জড়ানো ক্যারিয়ারটা শেষ হয়েছিল সবাইকে কাঁদিয়ে। ব্যাগি গ্রীন নাম্বার ৪০৮, অপরাজিত ৬৩ এই দুটি ছোটো বাক্যে বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের যুগ যুগ কাঁদিয়ে যাবেন হিউজ। হিউজের মতো এমন বিদায় যে কারো কাম্য নয়। ফেরার লড়াইয়ে মাঠে নেমে মাঠ থেকেই না ফেরার দেশে।
হিউজ মাত্র ১২ বছর বয়সেই করেছিলেন ‘এ’ গ্রেড সেঞ্চুরি। ১৭ বছরে পাড়ি জমান সিডনিতে। গ্রেড ক্রিকেটের অভিষেক ম্যাচেই ১৪১* রানের ইনিংস খেলে বুঝিয়ে দেন অনেক বড় লক্ষ্য নিয়েই বড় মঞ্চে পা রেখেছেন। সেই মৌসুমে ৭৫২ রান করে জায়গা করে নেন ২০০৮ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। নিউ সাউথ ওয়েলস দ্বিতীয় একাদশের হয়ে এক ম্যাচে ৫১ এবং ১৩৭ রানের দুটি ইনিংস খেলে সরাসরি জায়গা করে নেন রাজ্য দল নিউ সাউথ ওয়েলস মূল একাদশে। তাসমানিয়ার বিপক্ষে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় মাত্র ১৮ বছর ৩৫৫ দিন বয়সে। মাইকেল ক্লার্কের অভিষেকের (১৯৯৯ সালে) পর হিউজ ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ নিউ সাউথ ওয়েলস ক্রিকেটার। অভিষেক ম্যাচে ৫১ রান করেছিলেন তিনি। অভিষেক মৌসুমে করেছিলেন ৬২.১১ গড়ে ৫৫৯ রান, শেফিল্ড শিল্ড ফাইনালে সেবার করেছিলেন ১১৬ রান। তাতে শিল্ড ফাইনালের সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ানের রেকর্ড এখনো হিউজের দখলেই।
২০০৯ সালে ম্যাথু হেইডেনের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে জায়গা হয় সাউথ আফ্রিকা সফরে। প্রস্তুতি ম্যাচে ৫৩ রান করে অবসর নেন। যার ক্যারিয়ারের সব অভিষেক দুর্দান্ত হয়েছিল, তার টেস্ট অভিষেকটা মোটেই ভালো হয়নি। জোহানেসবার্গে প্রথম ইনিংসে ডেল স্টেইনের পেসে শূন্য রানে আউট হন হিউজ। সেটা ম্যাচের মাত্র চতুর্থ বলে, উইকেটের পেছনে মার্ক বাউচারকে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরেন হিউজ। তবে, দ্বিতীয় ইনিংসে হিউজের ব্যাট থেকে আসে দলীয় সর্বোচ্চ ৭৫ রান (১১ চার আর ১ ছক্কা)। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টে বিশ্ব রেকর্ডই গড়ে ফেলেন হিউজ। ডারবানে ম্যাচের প্রথম ইনিংসে করেন ১১৫ রান, তখনই ছুঁয়ে ফেলেন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ড। ২০ বছর ৯৬ দিনে ভেঙে দেন স্বদেশী ডগ ওয়াল্টারের রেকর্ড। ব্যাক-টু-ব্যাক সেঞ্চুরি করতে দ্বিতীয় ইনিংসে হিউজ করেন ১৬০ রান। সবচেয়ে কম বয়সে টেস্টের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করার বিশ্বরেকর্ড করেন হিউজ।
২০১৫ বিশ্বকাপের আগে মাইক হাসির অবসরে ওয়ানডেতে সুযোগ হয় হিউজের। ২০১৩ সালের ১১ জানুয়ারি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মেলবোর্নে ওয়ানডে অভিষেক হয় তার। ব্যাট হাতে ওপেনিংয়ে অ্যারন ফিঞ্চের সঙ্গী হন তিনি। নিজের অভিষেক ওয়ানডেতেই খেলেন ১১২ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। নিজের প্রথম ওয়ানডেতেই দলকে জেতান ১০৭ রানে, ম্যাচ সেরাও হন হিউজ। ওয়ানডে অভিষেকে প্রথম অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে সেঞ্চুরি করার রেকর্ডও গড়েন। সেই সিরিজের পঞ্চম ম্যাচে করেন ক্যারিয়ার সেরা ১৩৮*। একটিই মাত্র আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলার সুযোগ হয়েছিল হিউজের, করেছিলেন ৬ রান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১১৪ ম্যাচ খেলে ২৬টি সেঞ্চুরিতে করেছিলেন ৯০২৩ রান, ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ২৪৩*। লিস্ট ‘এ’ ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৯১ ম্যাচ, ৮টি সেঞ্চুরিতে করেছিলেন ৩৬৩৯ রান, ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ২০২*। ৩৩টি টি-টোয়েন্টিতে করেছিলেন ১১০৪ রান, ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৮৭*। ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান করে অপরাজিত থাকা হিউজ মৃত্যুর আগে নিজের শেষ ম্যাচেও ছিলেন ৬৩ রানে অপরাজিত।
হিউজের শোকেসে থাকা পুরস্কার:
নিউ সাউথ ওয়েলস রাইজিং স্টার অ্যাওয়ার্ড: ২০০৭
ব্রাডম্যান ইয়ার ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার: ২০০৯
শেফিল্ড শিল্ড প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার: ২০০৮/০৯
ডোমেস্টিক প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার: ২০১২/১৩
ব্যক্তিগত জীবনেও সাদামাটা একজন ছিলেন হিউজ। মারা যাবার এক বছর আগে কিনেছিলেন ৯০ হেক্টর জমি, যেখানে একটি ফার্ম গড়ে তুলেছিলেন তিনি। থাকতে চেয়েছিলেন ফার্ম আর ক্রিকেট নিয়েই। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠেনি। হিউজের জার্সি নাম্বার ৬৪, চূড়ান্ত অবসরে পাঠিয়ে দেয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া, এই নাম্বার আর কাউকে দেয়া হবে না বলেও নিশ্চিত করেছে দেশটির ক্রিকেট বোর্ড। দক্ষিণ আফ্রিকায় অভিষেক টেস্ট সিরিজ খেলে ২০০৯ সালের মার্চে যখন জন্মস্থান ম্যাকসভিলে ফিরেছিলেন হিউজ, পুরো শহর তাকে অভিনন্দন জানাতে রাস্তায় নেমেছিল। পাঁচ বছর আগে ঘরের ছেলেকে দেখতে যেভাবে রাস্তায় ভীড় করেছিলেন ম্যাকসভিলের মানুষ, ২০১৪ সালে নিথর হিউজকে দেখতেও সেভাবেই ভীড় করেছিলেন শহরটির মানুষ। ‘বিএল-৯৫৪’ নম্বরের বড় একটি গাড়িতে করে হিউজের কফিন নিয়ে যাওয়া হয়। শহরবাসীরা খেয়াল করেছিলেন, ৯ আর ৫৪ যোগ করলে হয় ৬৩। যে রানে জীবনের শেষ ইনিংসে অপরাজিত রয়ে গেছেন হিউজ। হিউজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন শহরের জনসংখ্যার দ্বিগুণের বেশি মানুষ। সবার মাঝে একজনকে একটু আলাদা করেই দেখা গিয়েছিল। সিডনি ক্রিকেট মাঠে যার বাউন্সারে দুর্ঘটনা, সেই শিন অ্যাবোট ছিলেন সবচেয়ে বেশি আবেগাক্রান্ত। বন্ধুকে হারানোর ধাক্কা কয়েক বছর সামলে উঠতে পারেননি তিনি, ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন ক্রিকেট। হিউজের পরিবার আর বন্ধুদের প্রচেষ্টায় শোককে শক্তিতে রূপ দিয়ে আবারো ক্রিকেটে ফেরেন অ্যাবোট।
হিউজ নেই, আছেন তার সতীর্থরা, তার বন্ধুরা। তার হয়ে ব্যাট করছেন, সেঞ্চুরি করছেন, আকাশের পানে তাকাচ্ছেন আর অদৃশ্য এক কালিতে লেখা হচ্ছে-ফিলিপ হিউজ নট আউট। হিউজ তাই না থেকেও রয়ে গেছেন ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায়। যতবার কোনো বোলারের বাউন্সার ব্যাটসম্যানের হেলমেটে আঘাত করবে ততবারই বিচলিত ফ্যানদের মনে ফিরে আসবেন হিউজ। ফিরে আসবেন গভীর এক ক্ষত হয়ে, হিউজ ফিরে ফিরে আসবেন নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেও হিউজ থাকবেন ৬৩ নটআউট হয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৯
এমআরপি