চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: কবি হেলাল হাফিজের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বাক্যটি যেন পূর্ণতা পেলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আবাসিক হলগুলোতে ব্যবহৃত পানির রূপে গুণে। এখানে প্রতিদিন ঘোলা জলে নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীরা।
বালতি ভর্তি পানির দিকে যদি তাকান, আপনার দৃষ্টি যতই তীক্ষ্ণ হোক না কেন তা বালতির তলদেশে পৌঁছাতে অক্ষম হবে। বলা যায়- যে চোখ দিয়ে জমিন থেকে লক্ষ মাইল দূরে আসমানের তারা দেখতে পান অনায়াসে, সেই চোখের দৃষ্টি চবির আবাসিক হলে ব্যবহৃত পানি ভর্তি কোনো পাত্রের দু’চার ইঞ্চি নিচ অবধিও পৌঁছুবে না।
সরেজমিনে দেখা যায়, চবির এএফ রহমান হলের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ব্যবহৃত পানির টাঙ্কিগুলো সম্প্রতি পরিস্কার করা হয়। সেই টাঙ্কি থেকে বেরিয়ে আসা ময়লার পরিমাণ এতটাই বেশি যে, বৃষ্টির পানির ঢলও ধুয়ে নিতে পারেনি জমাটবদ্ধ ময়লার স্তুপকে। পানির টাঙ্কি থেকে বের হওয়া ময়লার আবরণের পরিমাণটা কয়েক ইঞ্চি পুরো। কমলা রঙের সেই ময়লার স্তুপ এখনো ঝলঝল করছে পানির টাঙ্কির চারপাশে। যে জল দেখলে আপনার হৃদয়েও আগুন জ্বলবেই। আর টাঙ্কির ভেতরে যদি ভুলক্রমেও চোখ পড়ে, তবে এ পানি ব্যবহারের অবশিষ্ট ইচ্ছেটুকুও হারাবেন।
এ এফ রহমান হলের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। তারা বলেন, এ পানি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অযু-গোসলের সময় পানি নাক-মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করছে। শিক্ষার্থীরা নিরুপায় হয়ে এমন পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। একজন শিক্ষক কি পারবেন- এমন পানি তার পরিবারের জন্য ব্যবহার করতে? সুপেয় পানিরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এএফ রহমান হলে থাকা প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একটি সুপেয় পানির লাইন। তাও সবসময় সেখানে পানি পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর শতশত কোটি টাকা বাজেট হলেও শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রার মান প্রতিনিয়ত কমেই চলছে। আর কোনো দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জীবন মান এতো নিম্ন বলে মনে হয় না।
পানিতে থাকা ময়লার পরিমাণটা নিরুপনের জন্য আমরা খুব ছোট (পাঁচ লিটার পরিমাণ) একটি পাত্রে পানি রাখলাম। একদিন পর দেখা গেলো- পাত্রের নিচে পানির প্রায় ১০ ভাগের একভাগই ময়লা জমেছে। এছাড়া দুটো সাদা বোতল পানি ভর্তি করে পানির রংটা পুরোপুরি বোঝার চেষ্টা করলাম। এতে দেখা গেলো পানিটি ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। এ যেন পানি নয়, উন্নত কোনো কোম্পানির ওরেঞ্জ কালারের কোল্ড ড্রিংকস। কে কবে দেখেছে এমন পানি!
অথচ এ পানি দিয়েই প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীরা কখনো কুলি, কখনো অযু বা গোসল করছে। যার ফলে নাক, মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করছে ব্যবহার অযোগ্য এ পানি। পাশাপাশি এ পানি ব্যবহারে বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ডা. আবু তৈয়ব বাংলানিউজকে বলেন, এ পানিগুলো খেলে পেটে ব্যাথা এবং ডায়রিয়া হতে পারে। এছাড়া গোসল বা জামাকাপড় ধোয়ার কাজে ব্যবহার করলে এলার্জি, মাথার চুল পড়ে যাওয়াসহ নানান ক্ষতি হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইলে কৃত্রিম উপায়ে পানিগুলো ব্যবহারযোগ্য করতে পারে।
এএফ রহমান হলে কর্মরত একাধিক স্টাফের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিজস্ব পাম্পিং সিস্টেমে মাধ্যমে যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হয়, সেটা যথেষ্ট হয় না। তাই আলাদা করে পানি উত্তোলনের জন্য মোটর স্থাপন করা হয়েছে। তবে সেখান থেকে ভালো পানি উঠছে না। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া পানিগুলো নিচতলার টাঙ্কিগুলোতে জমা হলেও তৃতীয়/চতুর্থ তলা পর্যন্ত পৌঁছে না। তাই অন্তত পানি সরবরাহ ঠিক রাখতে নিজস্ব মোটরের লাল রঙের পানিই সাপ্লাই দিতে হচ্ছে।
এএফ রহমান হলের ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট এসএম মোয়াজ্জেম হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, কিছুদিন আগেও শিক্ষার্থীরা পানির টাঙ্কি পরিষ্কারের কথা বলায় টাঙ্কি পরিস্কারের ব্যবস্থা করেছি। এরপর তো এমন হওয়ার কথা না। ঠিক আছে, আপনি আমাকে পানির ছবি দিন। হলের স্টাফদের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছি আমি।
চবির ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী ছৈয়দ জাহাঙ্গীর ফজল বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ৭টি পাম্প রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার ছাড়া অন্যকোনো পানি সরবরাহ করা হয় না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দুটি পাম্পে সমস্যা হচ্ছে। যার ফলে চবির আলাওল ও এফ রহমান হলের বিশুদ্ধ পানি তুলনামূলক কম পাওয়া যায়। যদিও খাবারের পানির জন্য আলাদা ফিল্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মাঝেমধ্যে পানি সংকুলান না হলে যেগুলোতে বিশুদ্ধ পানি উঠছে না, ওই পাম্প দুটো দিয়েও পানি সরবরাহ করতে হয়। মূলত পানির লেয়ার গুলো নিচে নেমে গেলে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি অন্য লাইন থেকে পানি সরবরাহ করে বিশুদ্ধ পানির সংকট সমাধান করতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩
এমএ/টিসি