চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের বিখ্যাত শিল্পী শেফালী ঘোষের কাল জয়ী ‘ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দেওয়ানা..’ কিংবা ‘মন হাছাড়া মাঝি তোর সাম্পানওত চৈত্যোন্ন...’ গানগুলোতে উঠে এসেছে সাম্পানের কথা। তবে কালের বিবর্তনে সেই সাম্পানের দেখা মেলে না এখন আর।
জোয়ার ভাটার নদী, সাগর মোহনা আর উপকূলের এই জনপদে নৌকার পরিচয় সাম্পান নামে। সেই জনপদের মানুষের জীবন জীবিকা, অর্থনীতি, যোগাযোগ, লোকজ সংস্কৃতি মিশে আছে সাম্পানের সঙ্গে।
সাম্পানসহ হারিয়ে যাওয়া সেসব নৌযান নিয়ে একটি নৌকা জাদুঘর তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রামে। জেলা প্রশাসন নির্মিত ডিসি পার্কের পাশেই নির্ধারণ করা হয়েছে এই জাদুঘরের স্থান। এর পাশেই নির্মাণ করা হবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ও পৃথক জাদুঘর। সেই নৌকা জাদুঘরে থাকবে একশোটিরও ওপরে ঐতিহ্যবাহী সব নৌকা।
প্রাথমিকভাবে ডিসি পার্কে চলমান ফুল উৎসবে প্রদর্শনী হচ্ছে নানা ধরনের ১৫টি নৌকার। দেশের নদনদী থেকে হারিয়ে যাওয়া এসব নৌকার পাশাপাশি থাকবে প্রতিটি নৌকার ইতিহাসও। শুধু তাই নয়, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে জেলেদের সংগ্রামের চিত্রও থ্রী-ডি প্রযুক্তির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হবে জাদুঘরে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফকরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ‘শুধু চট্টগ্রাম নয় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নৌকা, যেমন কোথাও বজরা নৌকা রয়েছে, কোথাও ময়ূরপঙ্খী, কোথাও পানসি কোথাও ডিঙ্গি, কোথাও বিগ, কোথাও আলিয়ার ডাঙ্গা, আর কোথাও বাঁশের ভেলা রয়েছে। একেকটি অঞ্চলে একেকটি নদী একেক ধরনের নৌকা, এবং সেই নৌকার যে ইতিহাস। সেটি আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্য এই জাদুঘরটি করতে যাচ্ছি। ’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে আমরা যে ফুল উৎসবের আয়োজন করেছি তার একটি কর্নারে ১৫টি নৌকার একটি প্রদর্শনী রেখেছি। এই ১৫টি নৌকার মধ্যে দুই ধরনের সাম্পান রয়েছে। একটি বড় ধরনের সাম্পান আরেকটি ছোট সাম্পান। এর বাইরে চাঁদ নৌকা রয়েছে, পানসি রয়েছে, বজরা রয়েছে, বিগ রয়েছে। সামনে আরো কিছু নৌকা যুক্ত হবে। ’
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমাদের নৌকা জাদুঘরের কাজ কিছুদিনের মধ্যে শুরু করতে যাচ্ছি। এ কাজ শুরু করতে আমাদের ৩ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত আগতে পারে। নৌকা জাদুঘরে শুধুমাত্র এই নৌকাগুলোর প্রদর্শনী থাকবে সেটি নয়। এর বাইরে নৌকার সঙ্গে পাল, দাড় ও বৈঠা থাকবে। এর পাশাপাশি সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে জেলেরা কী ধরনের সমস্যায় পড়ে থাকে অনেক সময় ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে টর্নেডো হয়ে থাকে। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে থ্রী-ডি এফেক্ট দিয়ে দর্শনের জন্য সেই চিত্র ফুটিয়ে তোলার। যাতে করে আমাদের দর্শনার্থীরা বুঝতে পারেন রিয়েল একটি অনুভূতি। সে বিষয়গুলো তুলে নিয়ে আসার পরিকল্পনা আছে আমাদের। আমরা আশা করছি সে কাজটি আমরা কিছুদিনের মধ্যে করতে পারব। ’
তিনি আরও বলেন, ‘নৌকা জাদুঘরের জন্য ফৌজদারহাট যে ডিসি পার্ক হয়েছে, তার পাশেই স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। তার পাশেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ এবং জাদুঘর হবে। সেখানে নৌকা জাদুঘরটি করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এবং স্থান নির্বাচনের পর আমরা তিনটি ধাপে নৌকা জাদুঘর বাস্তবায়ন করতে চাই। একটি স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা, একটি মধ্যমিয়াদী এবং একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার আলোকে করতে চাই। স্বল্পমেয়াদি যেটি, তার আওতায় আমরা ইতিমধ্যে নৌকাগুলো তৈরি করে নিয়ে আসছি, সামনে আরো কিছু নৌকা আসবে। প্রায় শতাধিক নৌকা যেন আমরা আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে মিউজিয়ামটিতে স্থাপন করতে পারি, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। ’
নৌকা জাদুঘরের অর্থায়নের বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের যে ডিসি পার্ক, ফুল উৎসব বা নৌকা জাদুঘরের যে কাজগুলো আমরা করেছি, সেটা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সীমিত অর্থের মাধ্যমে করেছি। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় আমাদের দুটো প্রজেক্ট একটি অনুমোদন হয়েছে, আরেকটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। যে প্রকল্পটি অনুমোদন হচ্ছে সেটা কিছুদিনের মধ্যে অর্থ ছাড় হবে। যে প্রজেক্ট অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে, সেটা অনুমোদিত হয়ে গেলে নৌকা জাদুঘরের কাজ শুরু হবে। ’
উল্লেখ্য, কিছুদিন আগেও যেখানে মাদকের হাট বসতো সেখানে এখন ফুলের মেলা। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ফৌজদারহাটে সাগর পাড় থেকে অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে ১২৭ জাতের ফুলের লক্ষাধিক গাছ লাগিয়ে গড়ে তোলা হয় ডিসি পার্ক। সেই পার্কে প্রতিবছরই হচ্ছে ফুল উৎসব। সেই উৎসবে শামিল হচ্ছেন হাজারো তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৪
বিই/পিডি/টিসি