কলকাতা: ‘কবিরাজি’ কথাটি শুনলে প্রথমেই মনে আসে কবিরাজি চিকিৎসার কথা। কয়েক বছর আগেও কবিরাজি ওষুধ দেখা যেতো প্রায় প্রতিটি ঘরে।
কিন্তু আজকের দিনে অ্যালোপ্যাথিকের দাপটে কবিরাজি চিকিৎসা বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়ছে।
তবে কলকাতার এক জনপ্রিয় খাবারের নাম কবিরাজি। পুরো নাম ‘কবিরাজি কাটলেট’। মূলত ভেটকি মাছের তৈরি হলেও চিকেন এবং মাটন কবিরাজি কাটলেট খুবই জনপ্রিয় কলকাতার ‘ফাস্ট ফুড’ প্রিয় মানুষদের মধ্যে।
এই কবিরাজি কাটলেট নামটির পেছনেও রহস্য আছে।
নামের প্রথমে কবি শব্দটি থাকলেও কবিতা বা কবিদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই এ কাটলেটের। এমনকি কবিরাজি কোনো ঔষধি বা কোনো কবিরাজি পদ্ধতিও এর সঙ্গে মিশে নেই।
তবে নামের সঙ্গে কবিরাজি শব্দটি জুড়লো কেমন করে?- এ প্রশ্নের উত্তরে কবিরাজি কাটলেট তৈরি করেন এমন কিছু দোকানি জানালেন- ‘কবিরাজি’ শব্দটি এসেছে ইংরেজি ‘কভারেজ’ শব্দটি থেকে। এ কাটলেটের ওপর ডিমের বিশেষ প্রলেপ দেওয়া হয়। সে কারণেই নাকি একে ‘কভারেজ কাটলেট’ বলতেন ইংরেজ সাহেবরা। সেই ‘কভারেজ কাটলেট’ উচ্চারণ পাল্টিয়ে ‘কবিরাজি কাটলেট’- এ পরিণত হয়েছে।
তবে গুগল বলছে, ব্রিটেনের এক সময়ের অতি জনপ্রিয় খাবার ‘কভারেজ কাটলেট’ মূলত কম তেলে ভাজা, প্যান ফ্রাই করা এক ধরনের কাটলেট। সেখানে কবিরাজি কাটলেট কড়াইয়ে ডুবো তেলে ভাজা। শুধু তাই নয়, কভারেজ কাটলেটের ওপর ডিমের যে ধরনের প্রলেপ দেওয়া থাকে, তার সঙ্গে কবিরাজি কাটলেটের কোনো মিল নেই।
কবিরাজি কাটলেটের ভেতরের মাছ বা মাংস মোড়া থাকে এক অদ্ভুত মোড়ক দিয়ে। দেখলে মনে হয়, যেন খাবারটি মোড়া আছে শত শত ডিমের তৈরি বুদবুদ দিয়ে। এটির সঙ্গেও ‘কভারেজ কাটলেট’- এর কোনো মিল নেই।
কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে থাকা বাংলার খাবারের ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন বই অবশ্য বলছে, বাংলাই রান্নায় পর্তুগিজদের প্রভাব যথেষ্ট। তার কারণ, ইংরেজরা ছাড়াও কলকাতা এবং পশ্চিম চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্তুগিজরা বসবাস করেছেন বেশ কয়েক বছর। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের রন্ধন প্রণালীর প্রভাব পড়েছে বাংলায়।
বইয়ে জানা গেছে, ১৭০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সম্ভবত ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের খাবারের ধরন থেকে এ কবিরাজি কাটলেট বাংলার রান্নাঘরে প্রবেশ করেছিল। কবিরাজি কাটলেট অনেক বেশি কাছাকাছি ‘টেম্পুরা ব্যাটার’ নামক ইউরোপীয় খাবারের। যেটির ওপরের অংশটি দেখতে একেবারে কবিরাজি কাটলেটের মত।
শুধু কবিরাজি কাটলেটই নয়, কলকাতার মিত্র ক্যাফের সুপরিচিত ‘চিকেন আফগানি কাটলেট’ বা ‘চিকেন নানবান’ থেকে শুরু করে পাকোরা- এ সমস্ত রান্নাও পর্তুগিজ রন্ধন প্রণালীর দান।
কবিরাজি কাটলেট তৈরির পদ্ধতি
প্রথমে মাছের কাঁটা ফেলে লম্বা টুকরো করে নিতে হবে। মাংস ব্যবহার করলে তার ভেতর থেকে হাড়গুলো বের করে নিতে হবে। এরপর মাছ বা মাংসের টুকরোটিকে লেবুর রস, জল এবং নুনের মিশ্রণে ১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে।
এরপর আদা, রসুন, মরিচ, পুদিনা পাতা, ধনিয়া বাটার মিশ্রণে এক ঘণ্টা মাছ বা মাংসের টুকরোটিকে মিশিয়ে রাখতে হবে। দিতে হবে প্রয়োজনমতো লবণ। এরপর একটি পাত্রে ডিম ভালো করে মিশিয়ে রাখতে হবে।
মাছ বা মাংসের টুকরোটি সম্পূর্ণ ডুবে যায় এমন পরিমাণ তেলে ভেজে নিতে হবে। এরপর তেলে ভাজতে থাকা মাছ বা মাংসের টুকরোটির ওপরে পাত্র থেকে ডিমের গোলাটি অল্প অল্প করে তেলে ছেড়ে দিতে হবে। এভাবে পুরো মাছ বা মাংসটিকে ডিমের গোলা দিয়ে মুড়ে দিতে হবে।
এভাবেই তৈরি হয় কবিরাজি কাটলেট।
তবে কবি বা কবিতার সঙ্গে সরাসরি যোগ না থাকলেও এর কাব্যিক গুণটিকে অস্বীকার করা যায় না। এ খাবারের উৎস পর্তুগিজ নাকি ব্রিটিশ- সে বিতর্ক চলতে পারে, তবে তার আগে অবশ্যই একবার খেয়ে দেখতে হবে কলকাতার বিখ্যাত ‘কবিরাজি কাটলেট’।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৬
ভিএস/এএসআর