কলকাতা: “আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা/ কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে” অনুপম রায়ের কথায় ‘চতুষ্কোণ’ চলচ্চিত্রে গানটি গেয়েছেন লগ্নজিতা চক্রবর্তী। কলকাতার বসন্ত আক্ষরিক অর্থেই এসে গেছে।
১৩ ফেব্রুয়ারি সরস্বতী পূজা এবং ১৪ তারিখ ভ্যালেন্টাইন ডে আর সেই উপলক্ষেই প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে কলকাতার গলি থেকে রাজপথ আর রাজপথ থেকে শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে প্রেম ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিটি কোনায় কোনায়।
সময়টা ৯০ এর দশক , তখন ভ্যালেন্টাইন সাহেব কলকাতায় তার বিশেষ ভক্তকুল গড়ে তুলতে পারেননি। তখন কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির কাছে সরস্বতী পূজা ছিল শুধুমাত্র ধার্মিক আচারের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছুটা বেশি। এই দিন নতুন পাজামা পাঞ্জাবি পরে ছাত্ররা আর মায়ের পাটভাঙা শাড়ি পরে ছাত্রীরা অন্তত একদিনের জন্য বেশ কিছুটা বড় হয়ে যেত।
বড় হওয়ার একটা ‘রোম্যান্টিসিজম’ আছে সেটা অস্বীকার করা যায় না। যে স্বাধীনতা কলেজে বা ভার্সিটিতে পড়া দাদা-দিদিরা সাড়া বছর ধরে পেত সরস্বতী পূজার দিন সেই অধিকারটাই পায় বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। নতুন প্রেমের জন্ম এই স্বাধীনতার হাত ধরেই। বিশেষ করে উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে।
কলকাতার বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজা হয়। এর মধ্যে একটি চালু রেওয়াজ আছে।
এক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অন্য বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের নিমন্ত্রণ করেন। আর এই নিমন্ত্রণের মাধ্যমেই বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পরিচয়ের বিষয়টি ঘটে।
সময়টা বসন্ত কাল, প্রকৃতি সাজিয়ে ধরেছে তার প্রেমের ডালি। সেই প্রেমে মানুষ জড়িয়ে পড়বে সে কথা বলাই বাহুল্য। আর বিষয়টি যখন সতেরো আঠার বছর বয়সীদের নিয়ে তখনো কোন কথাই নেই। শুধু বিদ্যালয় নয় প্রাইভেট টিউশন, নাচের স্কুল, সঙ্গীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে পাড়ার সরস্বতী পুজোতেও অন্তঃসলিলা থিমটি থাকে ‘প্রেম’।
কলকাতায় ছাত্র জীবন কাটিয়েছেন এমন মানুষ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না যে তিনি কোন সরস্বতী পূজাতেই একটি প্রেমে পড়েননি। ৯০ দশকের শেষ দিকে গ্যাট এবং ডাঙ্কেল চুক্তির প্রভাবে মুক্ত অর্থনীতির দিকে পা বাড়ায় ভারত। আর তার প্রভাব পরে ভারতের সমাজজীবনে।
সেই সময় থেকেই প্রবল ভাবে জনপ্রিয় হতে থাকে ভ্যালেন্টাইন ডে। এই সময় থেকেই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কলকাতার মনে তার পাকাপাকি বাসস্থান বানিয়ে ফেলন। শুরু হয় ভ্যালেন্টাইন ডে পালন। তবে খুব নিরপেক্ষ থেকেও বলা জায়, সমাজের সর্ব স্তরের নিরিখে নতুন পরিচয়, নতুন প্রেমের বিষয়ে আজও কলকাতায় ভ্যাল্যান্টাইন ডের থেকে আজও এগিয়ে আছে সরস্বতী পূজা। এমন কি ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপের যুগেও।
নতুন শাড়ির কোঁচা সামলে কোন কারণে যেন সাজের ব্যাঘাত না ঘটে সেই দিকে নজর দিয়ে চোখ কান খোলা রাখতে হয়। আসলে শাস্ত্র যতই দেবী সরস্বতীকে শিক্ষার দেবী বলুক না কেন প্রেমের সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বীকার করার উপায় নেই।
বিগত যুগে এই প্রেমের সম্পর্ক শুরু হোত চিঠি কিংবা ক্লাসের নোটবুক দেওয়া নেয়ার মাধ্যমে, আজ সেই সম্পর্কের শুরু হয় ফেসবুক আই ডি দেওয়া নেওয়ার মাধ্যমে। বলা হয় ভ্যালেন্টাইন ডে দিন নাকি দেখা হয় প্রেমিক প্রেমিকার। দেখা হয় কি হয় না সেটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এই কথা বলা যায়, নতুন প্রেম শুরু করার জন্য দুই চোখ খোঁজে আরও দুটি চোখকে।
প্রেম থাকবে আর বিতর্ক থাকবে না এটা সম্ভব নয়। সরস্বতী পূজা আর ভ্যালেন্টাইন ডে-এর প্রেম নিয়ে বিশুদ্ধ প্রেমবাদীদের মতে কৈশোরের এই প্রেম আসলে একটা মুহূর্তের ভালো লাগা, মনস্তত্ত্বের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ইনফ্র্যাচুয়েসন’। সত্যি ভালবাসার সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক নেই।
অনেকেই বলেন ভ্যালেন্টাইন ডে আসলে একটি কর্পোরেট প্রচার কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। ভালবাসার জন্য একটি নির্দিষ্ট দিনের কোন প্রয়োজন নেই। হয়ত নিন্দুকদের কথাই ঠিক, হয়তো বা ভুল। এর তাত্ত্বিক চুলচেরা বিশ্লেষণে না গিয়ে বলাই যায়, আসলে প্রেমের উৎযাপন সব সময়য়ই শুভ বার্তা নিয়ে আসে।
যখন গোটা পৃথিবীতে হিংসা, হানাহানি আর যুদ্ধের আবহাওয়া তখন শান্তি বর্ষিত করতে পারে একমাত্র প্রেম। আর সেই প্রেম আনতে পারে আঠারোর তরুণ প্রজন্মই। তাই সরস্বতী পূজা হোক বা ভ্যালেন্টাইন ডে স্বাগত প্রেম, স্বাগত বসন্ত।
২০১৬ সালে প্রেম দিবস ঠিক সরস্বতী পূজার পরের দিনই। আবার পশ্চিমবঙ্গে এই দুটি দিনই সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই আশা করাই যায় এই বসন্তে প্রেমে ভেসে যাবে কলকাতা থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে ভারত, বাংলাদেশ তথা গোটা পৃথিবী। আর সেটা তরুণদের হাত ধরেই।
শুরু করেছিলাম অনুপম রায়ের কথায় ‘চতুষ্কোণ’ চলচ্চিত্রে গানের দুটি লাইন দিয়ে শেষ করবো সেই গানেরই আরও দুটি লাইন দিয়ে “এই বসন্তে অনেক জন্ম আগে/ তোমায় প্রথম দেখেছিলেম আমি/ হেঁটেছিলেম নিরুদ্দেশের পানে/ সেই বসন্ত এখন ভীষণ দামী”
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪২ ঘণ্টা , ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬
ভি.এস/আরআই