কলকাতা: ‘খেয়ে এসেছেন নাকি গিয়ে খাবেন?’ কলকাতাবাসীরা নাকি বাড়ির অতিথিদের এই প্রশ্নটি আকছার করে থাকেন। এই অনুযোগটি মাঝে মধ্যেই আসে বাংলাদেশের বন্ধুদের কাছ থেকে।
অনুযোগের মধ্যে অণুর পরিমাণ অভিযোগ ও পরমাণু পরিমাণ কটাক্ষ থাকে। এটি মুখে না বললেও বেশ বোঝা যায়। কিন্তু বিষয়টি আসলে কী? সত্যিই কি কলকাতার মানুষ জেটগতির জীবনের সঙ্গে দৌড়াতে দৌড়াতে আতিথেয়তা ভুলে গেছে! নাকি এর পিছনে রয়েছে অন্যকোনো আর্থ-সামাজিক কারণ।
এই কারণ খোঁজার আগে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে নিলে, বিষয়টির মধ্যে প্রবেশ করতে সুবিধা হবে। ২০১২ সালে কলকাতা দেখতে এক প্রবাসী কলকাতাবাসীর সঙ্গে কলকাতায় আসেন জার্মানির নাগরিক অ্যালবেরিচ ও তার স্ত্রী। একে অতিথি, তার সঙ্গে আবার সাহেব।
দুপুরের খাওয়ার টেবিল যে নানা পদে সেজে উঠেছিলো শুধু তাই নয়, রীতিমতো জার্মান দম্পতিকে আরও খাওয়ার জন্য অনুরোধ প্রায় জোর করার পর্যায়ে চলে গেলো। খানিকক্ষণ সহ্য করে বোমাটা ফাটালেন অ্যালবেরিচ। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে তিনি জানালেন, জোর করে খাওয়ানো ভারতীয় সংস্কৃতি হতে পারে কিন্তু তারা এটি মোটেও পছন্দ করছেন না।
ওইদিন জার্মান দম্পতি আরও জানিয়েছিলো, যেটি প্রয়োজন তারা সেটি নিয়ে নেবেন।
অ্যালবেরিচের ওইদিনের আচরণ মস্ত বড় শিক্ষা দিয়েছিলো। বুঝতে পেরেছিলাম, আসলে দু’টি জায়গার সমাজ সংস্কৃতির বড় পার্থক্যগুলোর সঙ্গে সঙ্গে এই ছোট পার্থক্যগুলো থাকে যেগুলো সাধারণভাবে চোখে পড়ে না।
এবার আসি কলকাতাবাসীর কথায়। দুই বঙ্গে আতিথ্য নেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাংলাদেশে অতিথিদের নিয়ে আবেগ বিশ্বসেরা। যে উদ্বেলতা আমি দেখেছি, তার থেকে আতিথেওতার বিষয়ে অনেক কম আবেগপ্রবণ কলকাতার মানুষ। নিঃসন্দেহে বিষয়টি স্বীকার করে কলকাতার মানুষও।
তবে অবিভক্ত বঙ্গে কিন্তু এই পার্থক্যটি খুব বেশি ছলো না। তার প্রমাণ পাওয়া যায়, সেই সময়ের রচিত সাহিত্যের দিকে নজর রাখলে। কিন্তু আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির ক্রমবর্ধমান বদলের ফলে অতিথি অাপ্যায়নের চরিত্রে বদল হয়েছে।
এই বদল লক্ষ্য করা যায়, পরিবারের আয়তন বদলের মধ্যে দিয়ে। কলকাতায় যৌথপরিবার এখন প্রায় ইতিহাসের পাতায় স্থান নিয়েছে। সাত ঘর এক উঠানের দিন পেরিয়ে এখন ফ্ল্যাটবাড়ি। গড়ে একটি পরিবারে তিন থেকে চারজনের বেশি সদস্য প্রায় নেই। এর মধ্যে গৃহকর্তা ও গিন্নি দু’জনেই অফিসে বেরিয়ে যান। তাই আত্মীয় বন্ধুদের কাছে তাদের আবেদন বাড়িতে আসার আগে দয়া করে যেন তারা ফোন করে আসেন।
বাস্তবক্ষেত্রে না জানিয়ে এলে যেমন পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে না থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে, তেমনই থাকলেও প্রস্তুতির অভাবে পরিবারের সদস্যদের বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়।
কিন্তু প্রস্তুতির অভাব কেন? এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে এসে যায়। বাড়িতে কি অতিথি আপ্যায়ন করার মতো খাবার থাকে না?
কলকাতার মানুষ ‘টেকনোলজি’নির্ভর হলেও খাওয়ার ব্যাপারে কিন্তু টাটকা খাবার খেতে বেশি আগ্রহী। যাদের সম্ভব হয় তারা প্রতিদিনের বাজার প্রতিদিন করতেই পছন্দ করেন। যাদের সম্ভব নয়, তারা তাড়া পাড়ায় বিক্রি করতে আসা সবজি-মাছ বিক্রেতার কাছ থেকে কিনে নেন। যাদের একেবারেই সময় কম, তারা হয় কর্মক্ষেত্র থেকে ফেরার সময় বা সপ্তাহের বাজার একবারে করেন।
প্রতিদিনের বাজার প্রতিদিন করার কারণ যেমন একদিকে টাটকা খাবার প্রবণতা, অন্যদিকে কলকাতায় কম পরিমাণে কেনার সুবিধাও প্রতিদিন বাজার করার অন্যতম কারণ। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। কলকাতায় যেকোনো দোকানে কেউ যদি চান তবে ১শ গ্রাম ডাল বা সরিষার তেল কিনতে পারেন। অথবা আস্ত আমিষ থেকে ২শ গ্রাম মাছ-মাংস-মুরগি কেটে সহজেই কিনতে পারেন। অর্থাৎ যতটা প্রয়োজন। ফলে প্রতিটি পরিবার তাদের প্রয়োজন মতো জিনিষ প্রতিদিন কিনে নেওয়াতেই অভ্যস্ত। বিশেষ করে কাঁচা সবজি, মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি।
এই চিত্র কিন্তু ভারতের বেশিরভাগ শহরেই। এর প্রমাণ আমরা পাই, ভারতের অর্থনীতির বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমেই। ভারতের পাইকারি বাজারদরের সূচক (হোলসেল প্রাইস ইনডেক্স) গত ১৫ মাস ধরে ক্রমান্বয়ে নিম্নগামী। এর মধ্যে রয়েছে চাল, ডাল, সবজি, তেল, মাছ-মাংস ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, তেলসহ অন্য সামগ্রী। এর একটি বড় কারণ, খাদ্য ও পণ্য মজুদ করে না রাখা। সেটি যেমন দোকানের ক্ষেত্রে, তেমনই সাধারণ মানুষও পণ্য মজুদ করা থেকে দূরে থাকে। কারণ, যতোটুকু প্রয়োজন সেটুকু তারা যেকোনো সময় বাজারে গেলেই কিনতে পারেন।
ভারতে পণ্য মজুদ করার বিরুদ্ধে এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট-১৯৫৫ খুব কড়াভাবে প্রয়োগ করা হয়।
এর ফলে না জানিয়ে বাড়িতে অতিথি এলে তার জন্য মধ্যাহ্নভোজ বা নৈশভোজের ব্যবস্থা করা অনেক সময় অসুবিধার কারণ হয়ে ওঠে। তবে এটিও ঠিক, ডাল-ভাতে আপ্যায়নের ক্ষেত্রে সমস্যা হয় না।
আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কলকাতাবাসীদের অন্য একটি বিষয় নজর দেওয়ার মতো। বিশেষ করে এ প্রজন্মের পরিবারগুলো একটু অন্যভাবে একে অন্যের সঙ্গে সময় কাটায় ও খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টি পালন করে। হয়তো একটি পরিবার যেখানে গৃহকর্তা ও গিন্নী দু’জনেই চাকরি করেন, কিন্তু ছুটির দিনে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটাতে চান। অন্যদিকে তাদের বন্ধুদের একই অবস্থা।
কিন্তু ছুটির দিনে আয়োজন মানে একটি পরিবারের উপর কাজের চাপ অনেক বেশি। তাই সবাই রান্নার দায়িত্বটা ভাগ করে নেন। একেকজন একটি খাবার নিয়ে আসেন। এর ফলে আড্ডার সময়েও ঘাটতি হয় না, একজনের উপর অতিরিক্ত কাজের চাপও পড়ে না।
শেষে অন্য একটি ঘটনা তুলে ধরলে বুঝতে সুবিধা হবে। কর্মসূত্রে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় যাওয়া এক ব্যক্তি কলকাতার একটি বাড়িতে নিমন্ত্রণে গেছেন। পেশায় উচ্চপদস্থ ওই ব্যক্তি সেই বাড়িতে হাজির হয়ে আলাপ-পরিচয় শেষ হতেই গৃহকর্ত্রী করজোড়ে অনুরোধ করলেন, তিনি যেনো খেয়ে তবেই যান।
এই অনুরোধ শুনে কলকাতায় আসা ওই ব্যক্তি কিছুটা অবাক। তিনি প্রশ্ন করে বসলেন, বিশেষ করে তাকে কেন খেয়ে যেতে বলা হলো। সঙ্গে থাকা একমাত্র কলকাতার মানুষ হিসেবে প্রশ্নটি আমার কাছেই হাজির হয়। তাকে বুঝিয়ে বলতে হলো, এটি রেওয়াজ। সেই রেওয়াজের জন্যই গৃহকর্ত্রী তাকে বিশেষভাবে এ অনুরোধ করেছেন।
অনেকেই অনুষ্ঠানে হাজির থেকে সেটি উপভোগ ও অংশ নেন, কিন্তু সেখানে বসে খাবার খান না। তেল-মশলা বেশি দেওয়া রান্না একটু এড়িয়ে চলেন। তবে অনুষ্ঠানের অানন্দে শরিক হন।
পরিশেষে এ কথা বলা যায়, আসলে আন্তরিকতার অভাব নয়। আর্থ-সামাজিক অবস্থার পার্থক্যের জন্যই আতিথেয়তার ধরনের বেশ কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে ‘খেয়ে এসেছেন না গিয়ে খাবেন?’, এই কথাটি কলকাতার মানুষ অতিথিদের আকছার বলেন, এমন ধারণাটি কিন্তু সঠিক নয়। সামাজিক পরিস্থিতির পার্থক্যের জন্যই কিছুটা ভিন্ন মানসিকতা অবশ্যই রয়েছে। তবে আন্তরিকতার অভাব রয়েছে এটি কখনই বলা যাবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪১ ঘণ্টা,১৬ ফেব্রুয়ারি , ২০১৬
ভি.এস/