বাঙালি খাদ্য রসিক। সেটা যদি ভাত আর মাছ হয়, তাহলে তো অার কিছু বলারই থাকে না।
নীহারঞ্জন রায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস’ আদি পর্ব, নামের বিখ্যাত বইটি থেকে জানা যায় ভারতীয় উপমহাদেশে ঐতিহাসিক কাল থেকেই ভাত খাবার চল আছে। নানা অঞ্চলে ভাতকে নানা ভাবে খাওয়ার রীতি স্বমন্ধে জানা যায়।
ভাতের অার এক রেসিপি হল পান্তা ভাত। পান্তা ভাত গ্রামীণ বাঙলার খাদ্য অভ্যাসের এক অন্যতম অঙ্গ। ইতিহাসের পাতায় নজর রাখলে বেশ কয়েকটি প্রাচীন বইয়ের কথা জানা যায়। যেখানে বাঙালির ভাত খাওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতির বর্ণনা আছে।
এর মধ্যে একটি প্রাকৃত ভাষার গীতি কবিতার সংকলন ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’। ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’-এ গরম ভাতের সঙ্গে ঘি দিয়ে খাবার কথা বলা আছে। অপর একটি গ্রন্থ ‘নৈষধচরিত’। সেখানেও খাদ্য হিসেবে গরম ভাতের কথাই লেখা আছে। রবিদাস চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীতে ভাতের সাথে বাহান্নো পদ দিয়ে আহারের কথা আছে। সেখানেও ভাত কিন্তু গরম এবং ঝরঝরে। সঙ্গে আছে নানা রকমের মাছের কথা। এর মধ্যে ইলিশ মাছ বাঙালি জাতির যুগ যুগ ধরেই প্রিয় শুধু না ঐতিহ্যও বটে।
তবে মজার একটি প্রশ্ন তুলেছেন ‘বাঙালির ইতিহাস’-এর লেখক নীহারঞ্জন রায়। তিনি ইতিহাস ঘেঁটে কোথাও বাঙালির খাদ্য তালিকায় ডালের কথা খুঁজে পাননি। তার প্রশ্ন ছিল অতীতে কি বাঙালি ডাল খেত না? যেসব মাছের উল্লেখ বেশি ভাবে পাওয়া যায় তার মধ্যে মলা, পুঁটি, শোল উল্লেখযোগ্য। ‘বৃহধর্মপুরান’-এ রুপোলি আঁশ যুক্ত মাছ খাওয়ার কথা লেখা আছে। মনে করা হয় এই রুপোলি আঁশযুক্ত মাছই ইলিশ মাছ।
পান্তা ভাত। যা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। গ্রাম বাঙলার পান্তাভাত বেশ কিছুটা পরে শহুরে বাঙালির পদে যুক্ত হয়। তার সঙ্গে ইলিশ মাছের সাযুজ্য অন্য মাত্রা যোগ করে। কিন্তু শুধুই স্বাদ নয় পান্তা ভাতের পুষ্টি গুণ নিয়ে বর্তমানে রীতিমতো গবেষণা শুরু হয়েছে। ১০৪ বছর বয়েসে সদ্য প্রয়াত বডি বিল্ডার বিশ্বশ্রী মোনহর আইচ এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন তার খাবারের তালিকায় প্রতিদিন থাকতো পান্তা ভাত। তার স্বাস্থ্য বিকাশের অন্যতম পুষ্টি ছিল পান্তাভাত।
১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে থাকে ৭৩.৯১ মিলিগ্রাম আয়রন, পটাশিয়ামের ৮৩৯ মিলিগ্রাম এবং ক্যালসিয়াম ৮৫০ মিলিগ্রাম, যা গরম ভাতের থেকে অনেক বেশি।
গ্রামীণ অঞ্চলে যে সব মানুষরা কঠোর পরিশ্রম করেন তাদের খাদ্য তালিকায় পান্তা ভাত একটি আবশ্যিক খাবার। গবেষকরা বলছেন ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা ভাতে ইস্টের পরিমাণ (ভালো ব্যাকটেরিয়া) সাধারণ ভাতের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। যা খাদ্যগুণ বাড়িয়ে দেয়। তবে স্বাদের কারণে পান্তা-ইলিশ সকলেরই পছন্দ। সম্ভবত সেই কারণেই পয়লা বৈশাখের খাদ্য তালিকা থেকে সারা বছরের প্রিয় খাদ্য তালিকায় এসে গেছে বাঙালির পান্তাভাত আর ইলিশ মাছ।
একটি জাতির বিষয়ে আলোচনা উঠলে আবশ্যিক ভাবে সেই জাতির খাবারের কথা উঠে আসে। আবার কোনো একটি খাবারের কথা উঠলেই একটি বিশেষ জাতির কথা উঠে আসে। যেমন চীনাদের সঙ্গে চাউমিন, তিব্বতিদের মোমো, জাপানিদের সুসি কিংবা ইতালীয়দের পাস্তা। ঠিক তেমনি ভাবে বাঙালির খাবারের প্রসঙ্গ উঠলেই পান্তা ভাত আর ইলিশের কথা উঠে আসে। ইলিশে থাকে ওমেগা তিন ও ওমেগা ছয়। যা হার্ট এবং নার্ভের জন্য ভালো। অার পদ্মার ইলিশের কথা হলে গুণাবলীর সাথে যোগ মন মাতানো স্বাদ।
পদ্মার ইলিশ সহযোগে পান্তা ভাত এক অনবদ্য অনুভূতি জাগায়। পশ্চিমবঙ্গে পান্তা-ইলিশের চল আছে। কিন্তু বাদ পড়েছে পদ্মার ইলিশ। পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের একটাই আক্ষেপ সেখানে পদ্মার সুস্বাদু ইলিশ পাওয়া যায় না। ইলিশেও যেন কাঁটাতার!
তবে পান্তা ভাত খাওয়ার চল বাড়ছে। শুধু গ্রামের নয় শহরের অনেক স্বাস্থ্য সচেতন মানুষও নিয়মিত পান্তা ভাত খাওয়া শুরু করেছেন। আর মরশুমের সময় তার সঙ্গে ইলিশ মাছ হলে তো কথাই নেই।
তবে ইলিশ মাছ রক্ষা করার দায়িত্বও নিতে হবে বাঙালিকেই। আর সেই দায়িত্ব নিলেই বজায় থাকবে বাঙালির পান্তা –ইলিশের ঐতিহ্য।
বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬
আরআই