কলকাতা: ‘যেটা আপনাদের ইতিহাস আসলে সেটা আমাদের শিকড়’- স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে এমন কথাই শোনালেন প্রবীর দে। তৎকালীন এই রিফিউজি আজ সল্টলেকবাসী।
প্রধানত পাক বাহিনীর আক্রমণের কারণে ছিন্নমূল হওয়া পূর্ববঙ্গের মানুষ ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিলো। বিশেষ করে ১৯৭১ –এর সময়ে সব চেয়ে বেশি মানুষ পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। সে সময় কলকাতা ও সংলগ্ন বিভিন্ন অঞ্চলে ওসব মানুষ তাদের কলোনি গড়ে তুলেছিলো।
১৯৭১ সালের আগেও পঞ্চাশের দশক থেকেই পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল মানুষদের বড় অংশের বসবাসের জায়গা হয়ে উঠেছিল কলকাতা। যে সব অঞ্চলে এদের বসবাসের কলোনি গড়ে উঠেছিল সেই অঞ্চলগুলো বর্তমানে পাল্টে গেছে অনেকটাই। সময়ের নিয়মে পরিবর্তন হয়েছে সমাজ জীবনের। ১৯৫১ সালের ভারতের জনগণনার তথ্যে দেখা যায়, ওইসময় কলকাতার জনসংখ্যার শতকরা ২৭ ভাগ মানুষ ছিলো রিফিউজি।
একসঙ্গে অসংখ্য শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে আসার ঘটনা ঘটে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে।
মুক্তি যুদ্ধের প্রথম দিকের মাসগুলোতে প্রায় এক কোটি মানুষ পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলো, এবং ১৫ লক্ষর মত মানুষ আর ফিরে যায়নি।
এসব ফিরে না যাওয়া মানুষ কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় কলোনি করে বসবাস শুরু করেন। একদিকে ছেড়ে আসা মাটির টান আর অন্যদিকে নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। এই দুইয়ের টানাপড়েনের স্পষ্ট ছাপ পড়ে জীবনযাত্রায়।
সেই জীবনযাত্রায় এসে মেশে জমির মালিকদের সঙ্গে লড়াই থেকে শুরু করে রাজনীতি। সময়ের কষ্টি পাথরে বারবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে এই রিফিউজিদের। ১৯৭১ সালে প্রায় যে এক কোটি শরণার্থী এসেছিলো বলে জানা যায়, তাদের একটা বড় অংশ বসবাস শুরু করে কলকাতা এবং তার আশপাশের এলাকায়।
বনগাঁ সীমান্ত পেরিয়ে বহু মানুষ শিয়ালদা স্টেশন দিয়ে প্রবেশ করেছিলো। তাদের সম্বল বলতে যা ছিল তা দিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবন ধারণ করা সম্ভব ছিল না। পূর্ব রেলের দক্ষিণ শাখার পরপর স্টেশন গুলিতে ধীরেধীরে গড়ে ওঠে রিফিউজি কলোনি। এর মধ্যে কসবা, ঢাকুরিয়া, যাদবপুর, বাঘাযতীন, গড়িয়া, নরেন্দ্রপুর, টালিগঞ্জ, আজাদগড়, বিজয়গড় ছিল অন্যতম।
এছাড়া ছিল কলকাতার কেষ্টপুর এলাকা। বর্তমানে যে অঞ্চলকে সল্টলেক বলা হয় এক সময় এই অঞ্চলে ছিল বড় বড় জলাশয়। আজকের কলকাতার আইটি হাব থেকে কিছুটা দুরেই কেষ্টপুর খাল। সেই খালের ধার ধরেই এক সময় গড়ে উঠেছিল রিফুজি কলোনি। যা আজ পরিণত হয়েছে অভিজাত এলাকায়।
আজকের যাদবপুর, বিজয়গড়, আজাদগড়ের মতোই অনেকটাই বদলে গেছে সেই সময়ের কেষ্টপুর খালের সংলগ্ন অঞ্চল। সেখানে গড়ে উঠেছে আইটি শিল্পক্ষেত্র। এক সময়ের হোগলা পাতা আর সরকার থেকে দেওয়া টিনের তৈরি রিফুইজিদের ঘর সংলগ্ন এলাকায় এখন আকাশচুম্বী অট্টালিকা। যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন দেশ বিদেশের বিভিন্ন আই টি-এর কাজ করে চলেছেন। কলকাতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অদূরে এই অঞ্চলে এখন তৈরি হয়েছে আধুনিক শপিং মল থেকে গগনচুম্বী অট্টালিকা।
ইতিহাস ঘেঁটে যা জানা যাচ্ছে, সল্টলেক রিফিউজি ক্যাম্পে ছিলেন প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ। এটাই ছিল কলকাতার সবচে’ বড় রিফিউজি ক্যাম্প। ক্যাম্প চালু হবার পাঁচ মাস পর একটি সরকারি সমীক্ষা চালানো হয়। সেই সমীক্ষার রিপোর্টে দেখা যায়, এই ক্যাম্পে শিশু মৃত্যুর হার ছিল খুব বেশি। এছাড়া বেলেঘাটা, দমদম ক্যান্টনমেন্ট, মধ্যমগ্রাম অঞ্চলেও বহু মানুষ বসবাস শুরু করেছিলেন।
অঞ্চলে ঘুরলে প্রবীণ মানুষদের কাছে জানা যায়, ঐসময়ে সীমান্ত পেরিয়ে এমন কিছু মানুষ সল্টলেকের ক্যাম্পে এসেছিলেন যারা পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় গুরুতর জখম ছিলেন। বিভিন্ন সময় মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যেত ক্যাম্পের আশপাশে।
এসব অঞ্চলের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে এমনই অনেক ইতিহাস যার অনেক কিছুই সঙ্কলিত হয়নি। এসব স্থানে ঘুরলেই বোঝা যায়, সাধারণ মানুষের কাছে আজ যেটা ইতিহাস সেটাই তাদের অতীত কিংবা শিকড়।
বাংলাদেশ সময় ০৭০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬
ভিএস/জেডএম