প্রথম মসজিদটি ধর্মীয় কারণে নির্মিত হলেও দ্বিতীয়টি নির্মাণের পেছনে শুধু উপাসনার উদ্দেশ্য ছিলো না, সেই সাথে একটি মিউজিয়ামের পরিকল্পনাও ছিলো।
ঐতিহাসিক এই দুটি মসজিদের নথি জোগাড় করা খুবই দুষ্কর।
মুখেমুখে ফিরলেও মসজিদ দুটির ইতিহাসের সন্ধান পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। মসজিদের ইতিহাসের সন্ধান করতে গিয়ে জানা গেলো টিপু সুলতানের পরিবারের অনেকেই জীবিত। কেউ থাকেন অট্টালিকায়, কেউ বা আবার রিকশাচালক। পরিবারের গল্প না হয় আরেক দিন হবে। আজ মসজিদ নিয়ে। প্রিন্স গোলাম শাহ ওয়াক্ফ ট্রাস্টি থেকে যে তথ্য পাওয়া গেলো তাতেও সন্তুষ্ট হওয়া গেল না। কিছু নথি থাকলেও ঘাঁটার ইচ্ছা নেই কারোর।
টিপু সুলতানের ১১তম ও সবচেয়ে কনিষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ প্রিন্স গোলাম শাহ দ্বারা নির্মিত প্রথম মসজিদটি ধর্মতলা অঞ্চলে। ১৮৩২ সালে ধর্মতলায় জমি কিনে এই সুন্দর মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন তাঁর বাবা টিপু সুলতানের স্মরণে। যা সম্পন্ন হয় ১৮৪২ সালে। ১৬টি গম্বুজ ও ৪টি মিনারসহ মসজিদটি নির্মিত। মসজিদের ভিতর ধারণক্ষমতা ১৫শ মানুষের। ঈদের সময় মসজিদটিকে কেন্দ্র করে প্রায় পনেরো হাজার মানুষ নামাজ আদায় করেন। এটি কলকাতার স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি বড় নিদর্শন। পর্যটদের কাছে কম আকর্ষণের নয় মসজিদটি।
১৯৮০-র দশকে মাটির তলা দিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণের সময় টিপু সুলতান মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেরামত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে টিপু সুলতান শাহী মসজিদ সুরক্ষা ও কল্যাণ কমিটি এবং মেট্রোরেলের যৌথ প্রচেষ্টায় মসজিদটির পুনরুদ্ধার হয়। ফের ২০০৪ সালে সুনামি ঝড়ের কারণে মসজিদটি আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মসজিদ কমিটিকে ২১হাজার ৫শ ডলার দান করেন। ফলে আসল মসজিদটির স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক অবলুপ্তি ঘটে।
টিপু সুলতান মহীশূরের নবাব থাকা সত্বেও কেন তাঁর ছোট ছেলে মহীশূর থেকে দূরে তাঁর বাবার স্মরণে কলকাতায় এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন এর পিছনেও আছে একটি ইতিহাস। বতর্মানে অঞ্চলটি দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে অবস্থিত।
ওয়াদিয়ার রাজবংশের রাজত্বকালে ১৭৫০-এর দিকে সুলতান হায়দার আলীর জ্যেষ্ঠ পুত্র টিপু সুলতান মহীশূরের নবাব হন। পুরো নাম সৈয়দ ওয়াল শরীফ সুলতান ফতেহ আলী সাহাব টিপু। টিপু সুলতানের রাজত্বকাল ছিলো ১০ নভেম্বর ১৭৫০ থেকে ৪ মে ১৭৯৯ পর্যন্ত্য। একদিকে তিনি যেমন সুলতান ছিলেন, অপরদিকে ছিলেন বড় মাপের পণ্ডিত ও কবি। মহীশূরের রাজধানী শ্রীরাঙ্গাপাতনম ব্রিটিশ বাহিনী দখল করে নেয়। ব্রিটিশ বাহিনীর দখলের পর এবং টিপু সুলতানের মৃত্যুর ছয় বছর পর, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক ১৮০৬ সালে টিপুর সমস্ত পরিবারকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়। তার কারণ একদিকে রাষ্ট্র থেকে ছত্রভঙ্গ করা এবং গোটা পরিবারকে যাতে নজরদারি করা যায়। ধীরে ধীরে তাঁরা হয়ে ওঠেন কলকাতাবাসী। টিপু সুলতানের পুত্র, গোলাম মোহাম্মদ যখন কলকাতায় আসেন তখন তিনি ছিলেন ছোট্ট শিশু। তিনিও ছিলেন তাঁর পিতার মতই বিভিন্ন গুণাবলী সম্পন্ন। জড়িত ছিলেন নানাবিধ সমাজকল্যানমূলক কাজের সাথে।
টালিগঞ্জে দ্বিতীয়টি মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি একটি মিউজিয়াম বানানোর পরিকল্পনাও করেন গোলাম মোহাম্মদ। একবিঘা তালাব সহ পাঁচ বিঘা (১শ কাটা) জমির পশ্চিম পাশে মসজিদটি অবস্থিত। যেখানে ধর্মীয় কাজের সাথে সাথে, কলকাতার জনগণ জানতে পারবে পিতার ঐতিহ্য। মিউজিয়ামটির নাম দেন 'মহীশূরের টাইগার'। কারণ টিপু সুলতান ‘টাইগার অফ মহীশূর’ নামেও পরিচিত ছিলেন। তবে জাদুঘরটি টিপু সুলতান মসজিদের সামনে স্থাপন করা হবে না। এটা করা হবে কিছুটা দূরে। যেখানে থাকবে সুলতানের ব্যক্তিগত বস্তু এবং সামরিক অস্ত্র ও কামান। যে কামানে লোহার গোলা ব্যবহার করে শত্রুদের আঘাত হেনে ছিলেন।
পাচটি বৃহৎ গম্বুজ, চারটি বড় মিনার ও ১৬টি ছোটো মিনার দ্বারা মসজিদটি নির্মিত। ধারণক্ষমতা ১০হাজার। ঈদের সময় মসজিদটিকে কেন্দ্র করে প্রায় ১০ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করেন।
কিন্তু বর্তমানে টালিগঞ্জের মসজিদের পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। কোনো এক অদ্ভুত কারণে বছরের পর তালাবটি পানিশূন্য। তবে মিউজিয়ামের কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না। এখানে সুলতানের বংশধরের ১৩ জন আত্মীয় কবরে শায়িত। সময়ের সাথে সাথে কবরের চাকচিক্য বাড়লেও একজনও আত্মীয়র নাম খোদাই করা নেই তাতে। ১৬টি গোপন ক্যামেরা দিয়ে সর্বক্ষণ নজরদারী চললেও হেলায় পড়ে রয়েছে কামানের অংশ বিশেষ। কামানগুলি আজ বাতিস্তম্ভ বা কোথাও লম্বা করে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে। জানা যায়, এই কামানের মধ্যে লোহার গোলা ঢুকিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার লর্ড ওয়েলেসলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন টিপু সুলতান।
বর্তমানে মসজিদটিকে সুসজ্জিত করে ধর্মীয় কাজ নিয়ম মাফিক করা হলেও ইতিহাস কিন্তু ধুলোমাখা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ইতিহাস যত ক্ষয় হতে থাকবে, প্রজন্ম তত অস্বচ্ছ হবে। নাখোদা মসজিদের পর কলকাতায় দুটি টিপু সুলতান শাহী মসজিদই ইতিহাসের পাতায় বড়ো নিদর্শন, তবে তা এখন শুধুই নামে!
বাংলাদেশ সময়:১৩১৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৭
জেএম/