প্রতিবার বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডেই শোনা যায়, এবারের আসরটা অন্যরকম, অনেক বেশি ওপেন, যে কেউই হয়ে যেতে পারে শেষের নায়ক। দ্বিতীয় রাউন্ডেও এরকম কথা একটু আধটু চলতে থাকে।
পেলে যুগের অবসানের পর ১৯৭৪ থেকে গত ১০টি বিশ্বকাপে এরকম আচানক সেমিতে আসা দল: উরুগুয়ে (২০১০), পর্তুগাল (২০০৬), তুরস্ক (২০০২), সাউথ কোরিয়া (২০০২), ক্রোয়েশিয়া (১৯৯৮), সুইডেন (১৯৯৪), বুলগেরিয়া (১৯৯৪), ইংল্যান্ড (১৯৯০), বেলজিয়াম (১৯৮৬) এবং পোল্যান্ড (১৯৮২ ও ১৯৭৪)। এর মধ্যে ৮২-তে বনিয়েকের পায়ে পোল্যান্ড, ৯০ বিশ্বকাপে লিনেকারের ইংল্যান্ড, ৯৪ সালে দাহলিন-ব্রোলিনের সুইডেন ও স্টয়চকভের বুলগেরিয়া এবং ২০০৬ সালে পর্তুগালের সেমিতে উঠা মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিলো না। এদের মধ্যে উরুগুয়ে আবার ১৯৩০ এবং ১৯৫০ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন, ইংল্যান্ড ১৯৬৬ সালের। একটু ব্যতিক্রম শুধু ২০০২ সাল। এশিয়ার জন্য প্রথম ওই বিশ্বকাপে আচানক সেমিতে উঠে গিয়েছিলো একসঙ্গে দু’ দল: সাউথ কোরিয়া এবং তুরস্ক।
এভাবে মাঝেমধ্যে দুয়েকটি দল সেমি পর্যন্ত গিয়ে চমক দেখালেও এবারের বিশ্বকাপে তাও হয় নি। গ্রুপ চ্যাম্পিয়নরাই দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিলো। এরপর টপ ফেভারিটরাই সেমিফাইনালে। বেলজিয়ামের নতুন ছেলেদের গোল্ডেন জেনারেশন বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের ‘তামা’ হিসেবে প্রমাণ করেছে। এটাও প্রমাণ হয়েছে, এখন পর্যন্ত তারা শুধু প্রতিপক্ষের ডি-বক্স পর্যন্ত যাওয়া দল। গোলকিপারকে হারিয়ে জাল খুঁজে পেতে হলে তাদেরকে কমপক্ষে আগামী বিশ্বকাপ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। একই অবস্থা কোস্টারিকারও। তারা কিছু সুযোগ পেলেও নেদারল্যান্ডসের দুর্ভাগ্য যে শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে জিততে হয়েছে।
তবে প্রত্যাশিতভাবেই সেমিফাইনালে উঠলেও আর্জেন্টিনার সেরা চারে আসা কিন্তু দুই যুগ পর। তারা সর্বশেষ সেমিফাইনাল খেলেছে ম্যারাডোনা যুগে, ১৯৯০ বিশ্বকাপে। রেফারি ফাইনালে হারিয়ে না দিলে ওইবার সব সময়ের সেরা খেলোয়াড় ম্যারাডোনা দ্বিতীয়বারের মতোও কাপটা নিজের হাতে নিতে পারতেন। তাঁর সেই ঐতিহাসিক ফাইনাল কান্না তো এখনও মানুষের চোখে আর হৃদয়ে। বাংলাদেশে যে আর্জেন্টিনার এতো বড় সমর্থক গোষ্ঠি তার ঐতিহাসিক কারণগুলোর অন্যতম ম্যারাডোনার ওই কান্না। শুরুটা অবশ্য ৮৬ সালে, তাঁর বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়ে। এর আগে আর্জেন্টিনা প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতেছিলো, নিজেদের আয়োজনে ১৯৭৮ আসরে।
এই দু’বার কাপ জয়, দু’বার রানার্সআপ; আর্জেন্টিনা সেমিফাইনাল খেলেছে আরো একবার। এবার সেমিতে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বি নেদারল্যান্ডসও তাদের সমান পাঁচ বার বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলেছে। ডাচদেরও আর্জেন্টাইনদের সমান তিনবার ফাইনাল খেলার রেকর্ড, তার একটি আবার ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনার সঙ্গে, বুয়েন্স আয়ার্সে। এস্তাদিও মনুমেন্টালের ওই ফাইনালে ৩-১ গোলে হেরে গিয়েছিলো একবারও বিশ্বকাপ জিততে না পারা ডাচরা।
তবে সেমির ইতিহাস দেখলে, জার্মানদের ধারে-কাছেও কেউ নেই। এ নিয়ে ১৩ বারের মতো তারা সেমিফাইনালে। এর মধ্যে ২০০২ থেকে টানা চতুর্থবার। আর তাদের প্রতিপক্ষ ব্রাজিল কাপ জয়ের ইতিহাসে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকলেও সেমির বিবেচনায় জার্মানির চেয়ে একটু পিছিয়ে। এ নিয়ে ১১ বার তারা শেষ চারে। সর্বশেষ তারা সেমিফাইনাল খেলেছিলো ২০০২ সালে, সেলেসাওরা যেবার ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে জয়েই জিতেছিলো রেকর্ড পঞ্চম বিশ্বকাপ, যাকে তাদের ভাষায় তারা বলে, পেন্টা।
এবার হেক্সা জয়ের মিশনে সেমিফাইনালেই তাদের প্রতিপক্ষ জার্মান ব্রিগেড। কিন্তু ওই লড়াইয়ে নেই যাকে ঘিরে হেক্সা জয়ের স্বপ্ন, সেই নেইমার। কার্ড সমস্যায় রক্ষণের প্রধান সেনাপতি দিয়াগো সিলভাও সেমিতে থাকবেন না। যুক্তির বিচারে অনেকে তাই এখানেই ব্রাজিলের সমাপ্তি দেখছেন। কিন্তু নেইমার ছাড়াও ব্রাজিল যে বর্তমান জার্মান দলের চেয়ে খুব পিছিয়ে এমন মনে করার কারণ নেই। গ্রুপ পর্বে ঘানা, দ্বিতীয় রাউন্ডে আলজেরিয়া আর কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্স সেটা দেখিয়ে দিয়েছে। নকআউট পর্বে জার্মানদের জয়ের নেপথ্যে কোচ জোয়াকিম লো’র রণকৌশল। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেই কৌশল মোকাবেলা করে পাল্টা কৌশলে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে ওস্তাদ ব্রাজিলের কোচ লুই ফেলিপে স্কলারি।
আর দু’ দলের পরস্পরের লড়াইয়ে ব্রাজিল তো অনেক এগিয়ে। এখন পর্যন্ত ২১ ম্যাচে ব্রাজিলের জয় ১২টিতে, জার্মানির ৪; ড্র হয়েছে ৫বার। বিশ্বকাপে ব্রাজিল-জার্মানি দেখা হয়েছে মাত্র একবার। সেই ইতিহাস তো সবারই জানা। ২০০২ বিশ্বকাপ ফাইনালে ২-০ গোলের জয়ে জিতেছিলো ব্রাজিল।
ব্রাজিলকে ওই বিশ্বকাপ জেতানো স্কলারি আবেগকে অতো গুরুত্ব না দিলেও দলকে অনুপ্রাণিত করতে এবার তাঁর বড় অস্ত্রের নাম হবে নেইমার। বর্তমান ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন নেইমারের জন্য একটি জয় ছিনিয়ে আনতে সবকিছু উজাড় করে দিয়েই খেলবে অন্যরা। আর যান্ত্রিক জার্মানরা নিজেদের মিশনের বাইরে কোনো কিছুকেই কেয়ার না করলেও ইলেকট্রিফাইয়িং হোম স্টেডিয়াম হবে ব্রাজিলের আরেক বড় অনুপ্রেরণা। সেই গ্যালারিতেও ঘুরেফিরে যার নাম আসবে, তিনি নেইমার। ব্রাজিলিয়ান এই সুপারস্টার এভাবে বিশ্বকাপে না থেকেও থাকবেন সবকিছুতে।
তবে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে নিজের মতো করেই মাঠে থাকবেন নেইমারের বার্সা সতীর্থ লিওনেল মেসি। তার জাদুতেই আবারো বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন আর্জেন্টাইনদের। ম্যারাডোনার মতো মেসিও বিশ্বকাপ এনে দেবেন এমন আশায় বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে আর্জেন্টিনার কোটি সমর্থক। সেই পথে আর্জেন্টিনাকে সেমি পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন ফুটবল বিস্ময়। আর মাত্র দু’ ম্যাচে কয়েক সেকেন্ড করে নিজের ঝলকটা দেখাতে পারলেই ১৩ জুলাই মারাকানায় মেসির ঠোঁটে বিশ্বকাপ।
নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে ফুটবল লড়াইয়ের ইতিহাস অবশ্য আর্জেন্টিনার পক্ষে কথা বলে না। দু’ দলের এখন পর্যন্ত ৮ ম্যাচে আর্জেন্টাইনদের জয় মাত্র ১টিতে, পরাজয় ৩ আর ড্র ৪। বিশ্বকাপ ইতিহাসও তাদের বিপক্ষে। ফুটবলের সেরা আসরে ৪ মোকাবেলায় ১ জয়ের বিপরীতে ২টিতে হার, আর অন্যটিতে ড্র। তবে ডাচদের বিপক্ষে সব মিলে যে একটি মাত্র জয়, সেটি অল ইম্পর্টেন্ট ৭৮ বিশ্বকাপের ফাইনাল।
তিন যুগ আগের ওই ইতিহাস আর্জেন্টাইনদের বড় অনুপ্রেরণা হলেও নেদারল্যান্ডস চোখ দেবে বর্তমানে। সেটাই তাদের মূল ভিত্তি। প্রথম ম্যাচেই স্পেনকে ধসিয়ে দেয়া ফ্লাইং ডাচম্যানদের এখন পর্যন্ত যে টর্নেডো গতি, তাতে রোবেন-পার্সি-স্নাইডাররাই অনেক এগিয়ে। পার্থক্য গড়ে দেয়ার ক্ষমতা শুধু যে একজনের, তিনি মেসি। তবে এ ম্যাচে ডাচ দূর্গ ভেদ করে আসল কাজটা তার জন্য বসনিয়া বা ইরান কিংবা নাইজেরিয়ার মতো সহজ হবে না। এমনকি নকআউট পর্বে পাওয়া সুইজারল্যান্ড কিংবা বেলজিয়ামের মতোও না। বাস্তবতা হচ্ছে গ্রুপ পর্ব থেকে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত সহজ সব প্রতিপক্ষই পেয়েছিলো আর্জেন্টিনা। সেমিফাইনাল তাই তাদের প্রথম আসল লড়াই।
মেসি ছাড়া আর সব জায়গাতেই এগিয়ে নেদারল্যান্ডস। আর সেই লড়াই যদি টাইব্রেকারে গড়ায় তা হলে কি হতে পারে, সেটাও দেখিয়েছেন পরিবর্তিত গোলকিপার টিম ক্রুল। ডাচরা অবশ্য এখন পর্যন্ত নিজেদের যেভাবে মেলে ধরেছে তাতে টাইব্রেকার পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে।
বিশ্বকাপের ইতিহাস বলছে, এখন পর্যন্ত পুরনো পা-ুলিপিতেই ব্রাজিল-জার্মানি এবং আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস সেমিফাইনাল লাইনআপ। তবে নতুন চিত্রনাট্য হয়ে যেতে পারে যদি সেমির পর ১২ এবং ১৩ জুলাই’র লাইনআপটা হয় যথাক্রমে এইরকম: আর্জেন্টিনা-জার্মানি এবং ব্রাজিল-নেদারল্যান্ডস।
বাংলাদেশ সময় ১৪৫৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০১৪